ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ঘরে তৈরি খাবারের ব্যবসা। বাংলা ও চাইনিজ দুই ধরনের খাবারই ঘরে তৈরি করে অনলাইনে বিক্রি করছেন নারী উদ্যোক্তারা। মূলত করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে অনলাইনে ঘরের খাবার ব্যবসার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার হয়েছে। বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৩০-৩৫ জন নারী উদ্যোক্তা নিজেরা ঘরে খাবার তৈরি করে অনলাইনে সেই খাবার বিক্রি করছেন।

অনলাইনে প্রতি মাসে ৩০ লাখেরও বেশি টাকার খাবার বিক্রি হচ্ছে। খরচের তুলনায় লাভ ভালো হওয়ায় অনেক নারী উদ্যোক্তা এখন অনলাইনে খাবার বিক্রির ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন। এ খাবারের ব্যবসা এখন নারীদের বাড়তি আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের প্রথম দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের কয়েকজন নারী উদ্যোক্তা ঘরে তৈরি খাবার অনলাইনে বিক্রি শুরু করেন। বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের পাশাপাশি আশুগঞ্জ উপজেলার ৩০-৩৫ জন নারী উদ্যোক্তা খাবারের ব্যবসা করছেন। একেকজন উদ্যোক্তা প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার টাকার খাবার বিক্রি করতে পারেন। সে হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতি মাসে ৩০ লাখ টাকারও বেশি মূল্যের খাবার বিক্রি হয় অনলাইনে।

মূলত করোনা মহামারি শুরুর পর সরকারি নির্দেশনায় রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন নারী উদ্যোক্তারা অনলাইনে খাবার বিক্রির ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েন। তাদের কেউ কেউ ফেসবুক পেজের মাধ্যমে খাবারের অর্ডার নেন। আবার কেউ কেউ ফুড ডেলিভারি অ্যাপ ফুড প্যান্ডার সঙ্গেও যুক্ত হন।

বাংলা ও চাইনিজ দুই ধরনের খাবারই তৈরি করেন নারীরা। এমনকি বেকারি পণ্য তৈরি করেও অনলাইনে বিক্রি করছেন তারা। রেস্টুরেন্টের চেয়ে ঘরের খাবার স্বাস্থ্যকর হওয়ায় ভোজন রসিকদের কাছে ঘরে তৈরি খাবার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এছাড়া রেস্টুরেন্টের তুলনায় ঘরে তৈরি খাবারের দামও কম।

অনলাইনে খাবার বিক্রি করা কয়েকজন নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হয়েছে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের। তারা প্রত্যেকেই খাবার বিক্রির ব্যবসা করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। অনলাইন ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান ‘টিফিন বক্স’র স্বত্বাধিকারী পলি আক্তার তেমনই একজন। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের হালদারপাড়ায়। গত বছর করোনায় তার স্বামী মারা যান। এরপর থেকে অনলাইনে খাবারের ব্যবসা করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করছেন। সব খরচ মিটিয়ে খাবার ব্যবসা থেকে প্রতি মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা আয় করছেন পলি।

পলি আক্তার বলেন, ‘২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে আমিই প্রথম অনলাইনে খাবার ব্যবসা শুরু করি। প্রথম দিকে তেমন সাড়া মেলেনি। গত বছরের জুন মাসে প্রবাসে থাকা আমার স্বামী মারা যান। এরপর থেকেই ঘরে তৈরি খাবার বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছি। এখন ব্যবসা অনেক ভালো চলছে’।

‘প্রথম প্রথম ফেসবুক পেজের মাধ্যমে খাবারের অর্ডার নিতাম। এখন ফোনেও অর্ডার নেই। এরপর ডেলিভারি ম্যানের মাধ্যমে অর্ডার ডেলিভারি করি গ্রাহকদের কাছে। বর্তমানে আমি বিভিন্ন ব্যাংক এবং হাসপাতালে খাবার সরবরাহ করছি। প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ হাজার টাকার খাবার বিক্রি করি’- উল্লেখ করেন পলি আক্তার।

আশুগঞ্জ উপজেলার নারী উদ্যোক্তা উম্মে হানি সারা বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু একটা করার চিন্তা থেকে আমি খাবার ব্যবসা শুরু করি। এখনও আমার পড়াশোনা শেষ হয়নি। মূলত শখের বশে এই ব্যবসায় নাম লিখিয়েছি। আমি নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের কথা চিন্তা করে সাশ্রয়ী দামে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার বিক্রি করি। আমার তৈরি করা বিভিন্ন ফাস্ট ফুড ও বেকারি আইটেমের চাহিদা বেশি’।

আরেক নারী উদ্যোক্তা ‘আশা’স বেকিং বিউটি’র স্বত্বাধিকারী শাহিদা আক্তার আশা বলেন, ‘আমাদের কোনো দোকান ভাড়া লাগে না, রেস্টুরেন্টের মতো বড় জায়গাও লাগে না। সেজন্য তুলনামূলক কম দামে উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করতে পারি। প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার টাকার খাবার ডেলিভারি করি। মূলত চাকরিজীবী এবং ব্যাচেলররা আমার কাছ থেকে খাবার নেন। বাংলা ও চাইনিজ খাবার সরবরাহ করি। জন্মদিনের কেকেরও অর্ডার থাকে। খাবার বিক্রি করে গড়ে আমার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত লাভ হয়। এ ব্যবসা এখন আবার বাড়তি আয়ের উৎস’।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরামের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট তাসলিমা সুলতানা খাসম নিশাত বলেন, ‘করোনা মহামারিতে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। তখন নারীরাই সংসারের হাল ধরেন। ঘরে তৈরি খাবার অনলাইনে বিক্রি করে নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এটি নারীদের এগিয়ে যাওয়ার একটি নিদর্শন। তবে নারী উদ্যোক্তাদের যদি ব্যবসার জন্য সরকারি প্রণোদনা বা ঋণ দেওয়া হয়, তাহলে তারাও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে’।

তবে অনলাইনে খাবার ব্যবসার মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তারা স্বাবলম্বী হলেও তারা সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করছেন না উল্লেখ করে তাদের ব্যবসায়িক নিয়ম-নীতি মেনে ব্যবসা করার জন্য বলছে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, ‘আমরা সরকারি নিয়ম-নীতি মেনে ব্যবসা করি এবং সরকারকে কর দেই। রেস্টুরেন্টে বাণিজ্যিক গ্যাস লাইন ব্যবহার হয়, কিন্তু নারী উদ্যোক্তারা ঘরে আবাসিক গ্যাস লাইন ব্যবহার করে ব্যবসা করছেন। তারা সরকারকে কোনো করও দেন না। আমরা চাই নারী উদ্যোক্তোরা ব্যবসার জন্য সরকারি যে নীতিমালা আছে, সেটি অনুসরণ করে ব্যবসা করুক’।

এসপি