শেরপুর জেলার ভারত সীমান্তবর্তী শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার অন্তত ৪০টি গ্রামে প্রতিবছর তাণ্ডব চালায় বুনো হাতির দল। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত হাতির আক্রমণে অন্তত ৭০ জন পাহাড়ি মানুষ মারা গেছে। এ সময় আহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। নষ্ট হয়েছে লাখ লাখ টাকার ফসলি জমি।

জানা যায়, বুনো হাতির তাণ্ডব থেকে পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষ ও ফসল রক্ষা করতে সরকার ও এনজিও বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু সেটির সুফল আসেনি। তাই এবার হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচতে দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম হাতে নেওয়া উচিত বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা।

শ্রীবরদির বালিজুরি গ্রামের আবু রায়হান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবারও শ্রীবরদী সীমান্তে হাতির তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। এ কারণে আতঙ্কে আছে এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। হাতির আতঙ্কে রাতে ঘুম নেই তাদের।

ঝিনাগাতী উপজেলার রাংটিয়া গ্রামের আনিসুর রহমান বলেন, মাঠ এখন পাকা আমন ধান ও শীতের সবজিতে ভরপুর। পাহাড়ি জনপদের অনেক কৃষকের সংসার চলে এসব বিক্রি করে। কিন্তু বুনো হাতির দল সারা দিন পাহাড়ের গহিন জঙ্গলে থাকলেও সন্ধ্যা হতেই খাবারের সন্ধানে নেমে আসে লোকালয়ে। এরা কৃষকের কষ্টের ফসল সবজি, পাকা ধান খেয়ে সাবাড় করে।

অন্যদিকে হাতি তাড়াতে সারা রাত ধরে চলে হাতি ও মানুষের যুদ্ধ। গত এক সপ্তাহে হাতির দল খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করছে অসংখ্য সবজি ফসল। ঢাকঢোল, পটকা ফুটিয়ে, ঘণ্টা, মশালসহ নানা কসরত করেও ঠেকানো যাচ্ছে না হাতিদের। এখন হাতির আতঙ্কে রাত জেগে জানমাল রক্ষা করতে হয় হাজারো মানুষকে।

শ্রীবরদি উপজেলার সিংগাবরুনা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আবু রায়হান বাবুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, শেরপুরের সীমান্তবর্তী মানুষদের হাতির উপদ্রব থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালে ১৩ কিলোমিটার-জুড়ে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে তার দিয়ে বেড়া নির্মাণ করে বন বিভাগ। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকার দেশগুলোর আদলে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এই প্রকল্পের নাম ছিল ‘সোলার ফেন্সিং’। প্রথম দিকে এটা কাজে এলেও তদারকির মানুষ না থাকায় অকেজো হয়ে আছে সোলার ফ্যান্সিং। সঠিক পরিকল্পনা ও লোকবলের অভাবে প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ায় সরকারের নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকা।

ঝিনাইগাতী উপজেলার তাওয়াকুঁচা গ্রামের কৃষক আলী হোসেন জানান, মূলত খাবারের সন্ধানেই বন্য হাতির দল লোকালয়ে আসে। হাতির তাণ্ডব ঠেকাতে আমরা নিজেরাই উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। সরকারের দেওয়া কোটি টাকার সোলার ফেন্সিং বিকল হয়ে পড়ে আছে। এ বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তাই আমরা জিআই তার ব্যবহার করে তাতে জেনারেটরের সংযোগ দিচ্ছি। এদিকে হঠাৎ ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বেড়ে গেল। ধান ও সবজি আবাদ করতে যে খরচ। তাই প্রতিদিন আগুন দিয়ে বা জেনারেটর চালিয়ে হাতি তাড়ানো আমাদের জন্য কষ্ট হয়ে যাবে।

বন্য প্রাণী গবেষক আদনান আজাদ ঢাকা পোস্টকে জানান, বুনো হাতি সাধারণত পাহাড়ি জনপদের মানুষের খুব কাছাকাছি থাকে। কারণ, এখন বনে বা পাহাড়ে কোনো খাবার নেই। একদল অসাধু মানুষ দিন দিন পাহাড় ধ্বংস করছে। এ জন্যই বুনো হাতির দল খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসছে।

বনে মানুষ যত বাড়বে, হাতির আক্রমণ ততই বাড়বে। কারণ, হাতির স্থায়ী আবাসস্থল নির্বিচারে বন্ধ করে মানববসতি গড়ে তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া হাতি যেসব খাবার খায় না, সেসব নষ্ট করে না। যেমন: করলা, তামাখ, কুল জাতীয় ফল, এসব চাষ করা যেতে পারে।

শেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ইতোমধ্যে কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করেছি। হাতির কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি সহযোগিতা পৌঁছে দিয়েছি। আরও যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাদের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

জাহিদুল খান সৌরভ/এনএ