চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৫ হাজার কোটির আশায় ৪ কোটি দিয়ে সর্বস্বান্ত ৫০ পরিবার

‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হবে। এই টাকা দিয়ে বাড়ি-গাড়ি, জমি কেনার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে টাকাগুলো আনতে যা যা করা প্রয়োজন তার সব করা হয়ে গেছে। কাগজপত্রের কাজও শেষ। শুধু টাকা আনতে ২ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে।’

‘এরপরই বাংলাদেশে চলে আসবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। একেকজন শেয়ার হোল্ডার হবেন কোটিপতি। সবার থাকবে শত শত বিঘা জমি, থাকবে বিভিন্ন শহরে বড় ফ্ল্যাট, আরও থাকবে কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল গাড়ি। তবে সবকিছুর আগে মসজিদে গিয়ে পবিত্র কোরআন শরিফ হাতে শপথ করতে হবে, কাউকে এটি বলা যাবে না!’

এসব প্রলোভন দেখিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে প্রায় ৫০টি পরিবার। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সহজ-সরল মানুষের ৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। ভুক্তভোগীদের রাতারাতি ধনী হওয়ার স্বপ্নকে পুঁজি করেই সক্রিয় হয় চক্রটি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার নামোশংকরবাটি, নতুনহাট, চরমোহনপুর, টিকরামপুর, উত্তর চরাগ্রাম, সদর উপজেলার কালিনগর, রামচন্দ্রপুরহাট এলাকার ৫০টি পরিবার জমানো টাকা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। কয়েকটি পরিবার আবার ধারদেনা করেও চক্রটিকে টাকা দিয়েছে। এ চক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন অনেকে। বিশেষ করে অসচেতন মানুষ তাদের ফাঁদে পা দিয়ে টাকা হারিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২ বছর ধরে এই চক্রটি কাজ করছে। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে পৌরসভার চরমোহনপুর-জামাইপাড়া এলাকা থেকেই শুরু হয় তাদের প্রতারণার কাজ। প্রথমেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৩৫ হাজার কোটি টাকার প্রলোভন দেখান তারা। পরে মসজিদে গিয়ে কোরআন শরিফ হাতে নিয়ে কাউকে না বলার শপথ করায় চক্রটি।

এরপর এ চক্রের দালালরা প্রথমে সখ্যতা গড়ে তোলেন। শর্ত থাকে, যারা টাকা দিয়ে শেয়ার হোল্ডার হতে চাই তাদেরকে ছাড়া কাউকে বলা যাবে না। তারা বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নেয় টাকা। এভাবে এলাকার সহজ-সরল মানুষ প্রতারকদের কথায় মুগ্ধ হয়ে তাদের ফাঁদে পড়েন। ২ বছরে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন মাধ্যমে ৪ কোটি টাকা হাতিয়েছে চক্রটি।

কোরআন নিয়ে শপথের পর শুরু হয় ‘পাদ্রী মিশন’! প্রতারণার শিকার চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার চরমোহনপুর-জামাইপাড়া এলাকার দুরুলের ছেলে রাজমিস্ত্রি আসমাউল (৩০) কয়েকটি ‘পাদ্রী মিশনে’ অংশ নিয়েছিলেন। ‘পাদ্রী মিশনে’র নামে মূলত তারা ঘোরাঘুরি আর পিকনিক করত।

ঢাকা পোস্টকে আসমাউল বলেন, আমার বাবার সঙ্গে প্রথমে তাদের পরিচয় হয়। পরে আমাকে মিশনে যাওয়ার কথা বলে ঢাকা থেকে ডেকে পাঠানো হয়। প্রথমদিন আমাদের মিশন ছিল দিনাজপুরের স্বপ্নপুরীতে। মাইক্রোতে করে ৮-১০ জন মানুষ গেলাম। হোটেলে উঠলাম, আশেপাশে  ঘুরলাম। পরেরদিন বলছে মিশন শেষ। বাসায় আসার দুই দিন পর আবারও মিশন রাজশাহী। এভাবে একই লোকজনের সঙ্গে সোনামসজিদ, নওগাঁ, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় পাদ্রী মিশনের কথা বলে পিকনিক ও ঘোরাঘুরি করে চলে আসে।

গ্রেফতার প্রধান আসামি রেজাউল ইসলাম (বাঁ দিকে), বিউটি, কাবির ও মিজানুর রহমান মিজান

প্রতারণার এই ঘটনায় দুটি পৃথক মামলা করেছেন দুইজন ভুক্তভোগী। একটি ৭১ লাখ টাকা ও অপরটি ৪০ লাখ টাকার প্রতারণা মামলা। চলতি বছরের ৯ মার্চ ৭১ লাখ টাকা প্রতারণার অভিযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালতে মামলা করেছেন এক ভুক্তভোগী দুরুল ইসলাম। এজাহারে ৭ জনকে আসামি করা হয়েছে।

মামলাটি সদর মডেল থানার ওসিকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দেন আদালতের বিচারক। পরে মামলাটি থানায় রেকর্ড হয়। মামলা হওয়ার পর থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রতারক সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য বিউটিসহ আরও কয়েকজন প্রতারক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে গা-ঢাকা দিয়েছেন। প্রতারক চক্রের সদস্য বিউটি বাড়িতে তালা দিয়ে সপরিবারে পালিয়েছেন।

মামলার সূত্র ধরে অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। প্রতারকরা নিজেদের ব্যাংক পরিচালক, কখনো সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, কখনো বিদেশি দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, কখনো পুলিশ কর্মকর্তার ভুয়া পরিচয় দিয়ে প্রতারণার পরিচয় দিয়ে আসছিলেন।

গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে অনেককে কোটিপতি বানিয়েছেন এমন প্রলোভনে প্রতারণার ফাঁদ পাতে চক্রটি। রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার লোভে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকেই। মূলত সারাদেশেই এই চক্রের একাধিক নেটওয়ার্ক আছে। মানুষের অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে প্রতারক চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

ভুক্তভোগী, মামলার নথি ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, মামলার প্রধান আসামি রেজাউল ইসলাম রেজা চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার চরমোহনপুর দক্ষিণপাড়ার মৃত নৈয়মুদ্দিন মাস্টারের ছেলে। এ মামলার ২ নম্বর আসামি মোসা বিউটি। তিনি চরমোহনপুর জামাইপাড়ার মো. আনারুল ইসলামের মেয়ে। বিউটির বাবা আনারুল ইসলাম ও মা সেমালী বেগম। চরমোহনপুর দক্ষিণপাড়ার মৃত বাক্কার মেম্বারের ছেলে কাবির, মৃত মুনসুর মাস্টারের ছেলে ব্যাংক কর্মকর্তা মিজান ও জেসি নামে এক নারীকে আসামি করা হয়েছে।

প্রতারক চক্রের ফাঁদে প্রথম পা দেন পেশায় কৃষক ভুক্তভোগী দুরুল ইসলাম। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, ‘২০১৯ সালের শুরুর দিকে প্রতারক সিন্ডিকেটের সদস্য বিউটির সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৩৫ হাজার কোটি টাকা আর সম্পদের প্রলোভন দিতে থাকে বিউটি। একপর্যায়ে তিনি ওই প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়ে যায়।’

‘মসজিদে গিয়ে কোরআন নিয়ে কাউকে না বলার শপথ করি। প্রবাসে থাকা দুই ছেলের উপার্জিত অর্থ একাধিক এনজিও থেকে ঋণ আর ধারদেনা করে ৭১ লাখ দিয়েছি বিউটিকে। একেক সময় একেক অজুহাতে টাকা নিতে থাকেন বিউটি। নওগাঁর সাপাহার, রাজশাহীর সিটির হাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, সুন্দরপুরে জমির মালিকানা দেবে বলে টাকা নিতেই থাকে।’ যোগ করেন তিনি।

রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার লোভে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকেই

নতুনপাড়া এলাকার শফিকুল ইসলামের ছেলে দুঃখু মিয়া বলেন, ‘প্রথমে দুরুল আমার কাছে এসে বলে কিছু টাকা ধার লাগবে, একটা ব্যবসা শুরু করেছি। এরপর দিব, দিচ্ছি বলে কয়েকদফায় ১৬-১৭ লাখ টাকা নেয়। পরে আমাদের কাছে সবকিছু খুলে বলে দুরুল। এরপর দেখি কয়েকদিন পরপর প্রতারক চক্রের সদস্য রেজা, কাবির, বিউটি পাদ্রী মিশন করে। এলাকায় মাইক্রো নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। টাকা চাইতে গেলে আজকাল করতে থাকে। শেষে বাড়িতে তালা দিয়ে পালিয়ে যায়। এতগুলো টাকা দিয়ে আমরা এখন খুবই অসহায়।’

নতুনমোড়ের সাদিকুল ইসলামের ছেলে কালামের কাছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা ধার নেয় দুরুল। কালাম বলেন, ‘এক সপ্তাহ বলে ধার নিয়েছে। এরপর এক মাস, দুই মাস বলে ২ বছর পেরিয়ে গেছে। আগে এতোটা বুঝতে পারিনি, তা না হলে টাকা দিতাম না। শুনলাম, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৩৫ হাজার কোটি টাকা নিতে গিয়ে তারা বিসিফ, ইডসসহ আরও কয়েকটি এনজিও থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ করেছে।’

উত্তর চরাগ্রামের মাসুদ বলেন, ‘দুরুল প্রথমে আমার কাছে কিছু টাকা ধার নেবে বলে আসে। কারণ জানতে চাইলে বলে বিদেশি অনুদান পাব তাই। মিজান, রেজা, বিউটি এলাকার প্রভাবশালী লোকজন। তাদের কথা শুনেই টাকাগুলো দিয়েছিলাম। ৫, ৩, ২, ১০ লাখ করে মোট ২০ লাখ টাকা দিয়েছি। পরে তারা টাকা দিতে টালবাহানা শুরু করলে মামলা করি। মামলার পরপরই তারা পালিয়ে গেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে সালিশে বসলেও এর সমাধান হয়নি। কারণ রেজার এক ভাই এসপি, আরেক ভাই সচিব।’

মামলার আসামি মিজান, রেজা ও বিউটির সাথে ভুক্তভোগীদের এসব টাকা আদান-প্রদানের বিষয়ে কথা বলার একাধিক অডিও রেকর্ড রয়েছে এই প্রতিবেদকের কাছে। এমনকি বিউটিসহ প্রতারক চক্রের সদস্যরা পালিয়ে যাওয়ার পর মিজান ও বিউটির একটি কথোপকথনের অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়।

মামলার এজাহারনামীয় ৫ নম্বর আসামি ব্যাংক কর্মকর্তা মিজানুর রহমান মিজান মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টকে জানান, মামলার বাদী ভুক্তভোগী দুরুল সম্পর্কে আমার দুলাভাই। শুনেছি ধারদেনা করে কোথাও টাকা দিয়েছেন। কাকে টাকা দিয়েছেন এটা পরে শুনেছি। একই এলাকায় বাড়ি হওয়ায় এ মামলার ১ নম্বর আসামি রেজাউলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের জামাইপাড়া এলাকা থেকেই শুরু হয় চক্রটির প্রতারণার কাজ

তিনি আরও বলেন, আমার দুলাভাই এ বিষয়টির মীমাংসার জন্য আমাকে বলেছিলেন। এমনকি মামলার সাক্ষী হতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি পেশাগত ব্যস্ততার কারণে এ উদ্যোগ নিতে পারিনি। সেই ক্ষোভেই হয়তো আমাকে আসামি করা হয়েছে। প্রতারণার সঙ্গে আমি কোনোভাবেই জড়িত নয়।

এ বিষয়ে কথা বলতে মামলার প্রধান আসামি রেজাউল ইসলাম রেজার বাসায় গেলেও তিনি কথা বলতে রাজি হননি। দ্বিতীয় আসামি ও প্রতারক চক্রের সদস্য বিউটির সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

টাকা হারিয়ে এখন সর্বস্বান্ত ৫০টি পরিবার। প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করে এখন তারাই বিপাকে। তাদের দাবি, আসামিদের পক্ষ থেকে মামলা তুলে নিতে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এ চক্রটি এতো শক্তিশালী যে, ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়েও তিনি সন্দিহান। 

এ ঘটনায় ৭১ লাখ টাকার প্রথম মামলা হওয়ার পর প্রতারক চক্রের প্রধান আসামি রেজাউল ইসলামকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে সদর মডেল থানা পুলিশ। তবে বাদীর সঙ্গে সমন্বয় করে মীমাংসার শর্তে জামিন নেন তিনি। কিন্তু জামিন নেওয়ার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও মীমাংসার কোনো উদ্যোগ নেননি তিনি।

বর্তমানে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির এসআই (উপপরিদর্শক) মো. ফজলু ঢাকা পোস্টকে জানান, তদন্ত কাজ প্রায় শেষের দিকে। তবে তদন্তাধীন বিষয়ে এখনই বিস্তারিত বলা যাবে না।

এমএসআর