ডিজেলের দাম বাড়ায় হতাশায় পড়েছেন সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের কৃষকরা। কৃষক সংগঠকরা বলেছেন, এখন উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, বিক্রয়ের সময় কৃষক বাজার মূল্য পাবে না, তাতে আবারও কৃষকদের ধান চাষাবাদে অনীহা চলে আসবে।

সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের বাদেরটেক গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল করিম। তিনি প্রতিবছর ‘২০ কেয়ার’ (৩০ শতাংশে ১ কেয়ার) জমিতে ধান চাষ করেন। এবারও করেছেন। জমিতে ইঞ্জিনচালিত সেচ পাম্প দিয়ে পানি দেন। এতে অনেক টাকা খরচ হয় তার। এবার ডিজেলের মূল্য লিটারে ১৫ টাকা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।

রেজাউল করিম বলেন, ২০ কেয়ার জমিতে আমন চাষ করেছি। প্রতিবছর ১৫০ থেকে ২০০ লিটার ডিজেল প্রয়োজন। গত মৌসুমে ১৩ হাজার টাকা সেচ বাবদ খরচ হয়েছে। এখন ১৫ টাকা লিটারপ্রতি বাড়ায় ৩ হাজার টাকা বেড়ে ১৬ হাজার টাকার বেশি সেচ বাবদ খরচ হবে। ধানের দাম না বাড়লে লোকসান গুনতে হবে। লোকসান হলে চাষাবাদ করব কীভাবে? শুধু রেজাউল নয়, হাওরাঞ্চলের অনেক কৃষকের একই প্রশ্ন।  

ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ায় বোরো চাষীদের উৎকণ্ঠা বেড়েছে। হাওরের জেলা হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জে আগামী বোরো মৌসুমে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রাও ব্যাহত হতে পারে, এমন শঙ্কাও আছে। 

কৃষকরা বলেছেন, বীজতলা প্রস্তুত করতেও ডিজেলচালিত টাক্ট্রর ব্যবহার করতে হয়। ডিজেলের দাম বাড়ানোয় টাক্ট্ররের খরচ বেড়ে যাবে। বাড়তি এই খরচ এখনই বহন করতে হবে কৃষকদের।

জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সংবাদপুর গ্রামের কৃষক মো. আবু সিদ্দিক বলেন, ডিজেল কেরোসিনের দাম বাড়ায় জমি চাষাবাদে খরচ বাড়বে। কিন্তু ধানের দাম বাড়বে কি না কেউ জানে না।

তিনি আরও বলেন, আমরা ছোট কৃষক, চাষ করার সময় আগাম ধানের ওপর টাকা ঋণ করি। গতবছর মহাজনের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা এনেছি। কথামতো বৈশাখ মাসেই ৫০ মণ ধান মহাজনকে দিয়েছি। সব মিলিয়ে আমাদের লোকসান হয় ধান চাষ করে। বাপ-দাদার পেশা ছাড়তেও পারি না। এবার ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে কীভাবে ফসল চাষ করব এখনও জানি না।

হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক রমেন্দ্র কুমার দে মিন্টু বললেন, তেলের দাম বাড়ার কারণে সুনামগঞ্জের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনিতেই কৃষকরা ধানের ন্যায্য দাম পায় না। বছর বছর লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে ধান। এবার মরার ওপর খাঁড়ার ঘার মতো অবস্থা হয়েছে।

প্রবীণ কৃষক নেতা অমর চাঁদ দাস বললেন, দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন কৃষকদের জন্যই হচ্ছে। সামনে বোরো মৌসুম কৃষকের কথা ভাবা উচিত সরকারের। বাসের মালিকরা আন্দোলন করায় ভাড়া বৃদ্ধি হয়েছে। কৃষকদের উৎপাদন খরচ বাড়বে, কিন্তু ধানের দাম বাড়ানোর কোনো আলাপ শুনি না।

কৃষক সংগ্রাম সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার বাদশাগঞ্জের বাসিন্দা খায়রুল বাশার ঠাকুর খান বললেন, ধান উৎপাদনে কৃষকদের দুই বছর আগেও অনীহা ছিল। গত দুই বছরে সেটি কিছু কেটেছিল। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কৃষকের মানসিক অবস্থা দুই বছর আগের অবস্থায় ফিরতে পারে। 

তার মতে, হাওরে এখন পাওয়ার টিলার, ধান মাড়াইয়ের মেশিন, পাওয়ার পাম্প সবই ডিজেল দিয়ে চালাতে হয়। গ্রামের কাছাকাছি জমি হলে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। দুর্গম হাওরে ডিজেল ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেই। আগে অনেক জমিতে প্রাকৃতিক সেচ যন্ত্র ব্যবহার করা হতো। পলিতে বেশিরভাগ এলাকা ভরাট হওয়ায় এখন যান্ত্রিক সেচ যন্ত্র ছাড়া উপায় নেই। আগে গরু দিয়ে চাষাবাদ হতো, এখন পাওয়ার টিলারই ভরসা। আগে ধান মাড়াই হতো গরু দিয়ে এখন হয় মাড়াই মেশিনে। এই অবস্থায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। কৃষক সেই অনুপাতে মূল্য পাবে না। আবারও চাষাবাদের উৎসাহ হারাবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক ফরিদুল হাসান বললেন, ডিজেলের দাম বাড়ায় চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হবে না। চাষাবাদের খরচ বাড়লে ধানের দামও বাড়তে পারে। কৃষকরা ধানের দাম কম থাকলেও চাষাবাদ ছাড়ে না। তারা পেশাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে। 

তিনি জানালেন, আগামী বোরো মৌসুমে দুই লাখ ২২ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমি চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সুনামগঞ্জে এই লক্ষ্যমাত্রা অবশ্যই পূরণ হবে।

সাইদুর রহমান আসাদ/এইচকে