পলাশের ব্যতিক্রমী ব্যায়ামাগার
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ফেসবুক, ইউটিউব, লাইকি, টিকটক ও বিগো লাইভের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে যুবসমাজ। আবার মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ছে। যুবসমাজকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফেরাতে গ্রামীণ পরিবেশে শরীর চর্চার এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের এপি পলাশ নামে এক যুবক।
উপজেলার ২নং মির্জাপুর ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামের আব্দুল আজিজের ছেলে এপি পলাশ। ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজে এমবিএ পড়ার পাশাপাশি তিনি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজ করেন। করোনাকালে কলেজ বন্ধ থাকায় নিজের গ্রামেই পরিত্যাক্ত নানা সামগ্রী দিয়ে শরীর চর্চা কেন্দ্র স্থাপন করেছেন। বর্তমানে সেখানে নিজের গ্রামসহ শহরের বন্ধুদের শরীর চর্চায় উদ্বুদ্ধ করছেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাড়ির আঙ্গিনায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইট-বালু, মাটি-সিমেন্ট, প্লাস্টিকের পাইপ, পরিত্যাক্ত পানির বোতল, গাছের ডাল, বাঁশ-খুঁটিসহ পরিত্যাক্ত বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে তৈরি হচ্ছে শরীর চর্চার সরঞ্জাম। এসব দিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে ডাম্বেল, বারবেল, পুলআপ বার, দড়িলাফসহ আধুনিক ব্যায়ামাগারের সব যন্ত্রপাতি তৈরি করা হচ্ছে। একদল তরুণ তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কোনো অর্থ ছাড়াই তৈরি করছেন ভারী ব্যায়ামাগারের এসব যন্ত্রপাতি। শরীর ও মন সুস্থ রাখতে প্রায় দুই বছর ধরে এমন সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ চালিয়ে নিয়মিত শরীর চর্চার মাধ্যমে সুঠাম দেহ আর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে গ্রামে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এক দল তরুণ।
বিজ্ঞাপন
ব্যতিক্রমী এই ব্যায়ামাগারের উদ্যোক্তা এপি পলাশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডা. জাহাঙ্গীর কবীর স্যারের পরামর্শে প্রথমে আমি আমার শারীরিক ওজন ৯২ কেজি থেকে ৬২ কেজিতে কমিয়ে আনি। তার অনুপ্রেরণায় এই ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এছাড়াও এই কর্মকাণ্ডে নিয়মিত উৎসাহ ও পরামর্শ দেন নিউইয়র্ক প্রবাসী ফাতেমা নাজনিন প্রিসিলা।
তিনি আরও বলেন, গ্রামের সাধারণ মানুষের পক্ষে ব্যায়ামাগারে গিয়ে শরীর চর্চা করা সম্ভব না। তাই শরীর ফিট রাখার জন্য পরিত্যাক্ত সামগ্রী দিয়ে ব্যায়ামাগারের যন্ত্রপাতি বানিয়ে আমরা শরীর চর্চা করি। কোমল পানীয়র পরিত্যাক্ত বোতলে বালু ঢুকিয়ে বারবেল তৈরি করা হয়েছে। ইট-সিমেন্ট আর বাঁশ দিয়ে বানানো হয়েছে ডাম্বেল। দড়ি, টায়ার, বাঁশ দিয়ে বানানো হয়েছে পুলআপ বার। সাইকেলের পুরাতন টিউব দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রেসিস্টেন্ট ব্যান্ড। এসব দিয়েই গ্রামের যুবসমাজের বড় একটি অংশ প্রায় দুই বছর ধরে নিয়মিত শরীর চর্চা করছেন। এখন প্রতিদিন ২০ জন এখানে শরীর চর্চা করেন।
এপি পলাশ বলেন, আমি চাই ইউটিউব-ফেসবুকে আসক্ত না হয়ে সবাই শরীর চর্চা করবে। বাসায় ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি নেই বা টাকা নেই এ ধরনের অযুহাতে শরীর চর্চা থেকে যুবসমাজ যেন দূরে না থাকে। সারাদেশে ব্যতিক্রমী এই বার্তাটি পৌঁছালে যুবসমাজ শরীর চর্চায় আগ্রহী হবে। নিয়মিত শরীর চর্চা করলে যুবসমাজ মাদকসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারবে না।
জিমে অংশগ্রহণকারী সবুজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাকালে কলেজ বন্ধ থাকার কারণে সবসময় বাড়িতে শুয়ে বসে মোবাইল ফোনেই সময় কাটত। এতে শরীরের ওজন বেড়ে যায়। এপি পলাশের শরীর চর্চা কেন্দ্রের কথা জানার পর তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি সেখানে যেতে বলেন। এরপর নিয়মিত সেখানে শরীর চর্চার মাধ্যমে আমার ওজন কমেছে। সেই সঙ্গে এনার্জিও অনেক বেড়েছে।
তিনি বলেন, পলাশের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। প্রতিটি গ্রামে এমন শরীর চর্চা কেন্দ্র থাকলে যুবসমাজ বিভিন্ন অপরাধ থেকে দূরে থাকতে পারবে।
শ্রীপুর গ্রামের সাবু বিশ্বাস ও তরিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পলাশ একজন উদ্যোক্তা। সে আমাদের গ্রামের যুবসমাজকে একত্রিত করে তাদেরকে জিমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার উদ্যোগে গ্রামের যুবসমাজ এখন জিমের প্রতি আগ্রহী। আগে যারা টিকটক ভিডিও করত, বিভিন্ন সময় ফোনে ভিডিও গেমে লিপ্ত থাকতো, পড়াশোনায় অমনোযোগী ছিল, তারা এখন শরীর চর্চায় ব্যস্ত।
মির্জাপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শ্রীপুর গ্রামে পলাশের নেতৃত্বে একটি ব্যায়ামাগার তৈরি করা হয়েছে। সেখানে নিয়মিত শরীর চর্চা করছে গ্রামের উঠতি বয়সী ছেলেরা। এতে কিশোর ও যুবসমাজ মোবাইল-ইন্টারনেট থেকে বিরত হয়ে নিজের শরীরের দিকে নজর দিচ্ছে। দেশের বিত্তবানরা যদি সহযোগিতার হাত বাড়ান তাহলে তাদের পক্ষে এই কাজগুলো আরও সহজ হবে।
শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কানিজ ফাতেমা লিজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এপি পলাশ যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তার এই উদ্যোগ যুবসমাজের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনবে। এমন উদ্যোগ যেন প্রতিটি পাড়া মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে।
আরএআর