রংপুর নগরের আইজিএস-ইন্টারন্যাশনাল গ্রামার স্কুলে প্রাঙ্গণে প্রশিক্ষণার্থীরা

মোহনা কিছুদিন আগেও বাসা থেকে একা বের হতে ভয় পেত। ভয় পেত রাস্তাঘাটে একা পথ চলতে। তার মনে এই ভয় এসেছিল সমাজের চারপাশের অসামাজিক ঘটনাগুলো থেকে। ঘরের বাইরে মা ছিল মোহনার সঙ্গী। তাই মাকে ছাড়া মোহনা কোথাও একা যেত না। কিন্তু দেড় মাসের ব্যবধানে সেই ভিতু মোহনা অনেকটাই বদলে গেছে।

এখন সব ভয়ভীতি আর জড়তাকে দূরে সরিয়ে প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে টিকিয়ে রাখার অদম্য চেষ্টা তার। সে হয়ে উঠেছে অদম্য সাহসী। কারণ, মোহনা রপ্ত করেছে আত্মরক্ষার কৌশল। তার মতো দেড় শতাধিক মেয়েই এখন বদলে গেছে। তাদের কেউ প্রাথমিক পড়ুয়া। আবার কেউ কেউ স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের। এই বদলে যাওয়ার পেছনে কাজ করেছে ‘পাওয়ারপাঞ্চ’ প্রকল্প।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘উই ফর দেম’ মেয়েদের আত্মরক্ষায় আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে এ প্রকল্পটি শুরু করেছে। বিনা টাকায় ২৬০ জন মেয়ের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই শেষে ১৫০ জনকে দেড় মাসের প্রশিক্ষণে আত্মরক্ষামূলক কৌশল শিখিয়েছে তারা। এবার মোহনা, সুবা নাহিয়ানের মতো মেয়েরা দৃঢ় সাহসিকতায় বাধা পেরিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম।

সরেজমিন রংপুর নগরের আইজিএস-ইন্টারন্যাশনাল গ্রামার স্কুলে প্রাঙ্গণে গিয়ে এসব সাহসী মেয়েকে দেখা যায়। তখন সবাই ব্যস্ত ‘সেল্ফডিফেন্স’-এর কৌশল রপ্তে। এ বিষয়ে কথা হয় মোহনা, সুবাদের সঙ্গে। তারা জানায় ভয়ের দেয়াল ভেঙে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার গল্প। পাওয়ারপাঞ্চ প্রকল্পের মাধ্যমে তারা শুধু আত্মরক্ষার কৌশলই রপ্ত করেনি। হয়ে উঠেছে আত্মবিশ্বাসী, নম্র, ভদ্র ও সাহসী মানুষ।

প্রশিক্ষণে তারা রপ্ত করেছে আত্মরক্ষার কৌশল

এ বিষয়ে উম্মে তাহমিনা রেজা মোহনা ঢাকা পোস্টকে বলে, কিছুদিন আগেও দেশে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণে অন্যদের মতো আমি নিজেও অনেক ভয়ে ছিলাম। এরপর আমি উই ফর দেম-এর পাওয়ারপাঞ্চ ইভেন্টের কথা আম্মুকে জানালে বাসা থেকে সম্মতি পেয়ে যাই। তারপর প্রশিক্ষণ থেকে আমি সেল্ফডিফেন্স এবং কারাতের কৌশল ও জাপানিজ শব্দ জানতে পারি।

আমার মধ্যে অনেক আত্মবিশ্বাস ও সাহস তৈরি হয়েছে জানিয়ে মোহনা বলেন, আগে যেমন ভয় পেতাম, নিজেকে সেভ মনে হতো না। এখন আর তা মনে হয় না। আমি এখন নিজেকে সেভ মনে করি। কেউ এসে হাত ধরলে ছাড়াতে পারব, কটূক্তি করলে তার প্রতিবাদ করতে পারব। আমি এখন নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সাবলম্বী মনে করি। আমি যে মেয়ে, এটা এখন আর মনে হয় না। মনে হয় আমি মানুষ।

মোহনার মা রউফা বেগম মেয়ের আত্মবিশ্বাস দেখে এখন নিজেও সেই প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী। তিনি বলেন, আমার মেয়ের সাহস, শক্তি ও আত্মবিশ্বাস জানার জন্য তাকে প্রশিক্ষণে দিয়েছি। প্রথম কয়েক দিন আমি মোহনার সঙ্গে প্রশিক্ষণ দেখতে গিয়েছিলাম, কিন্তু এখন আর যেতে হয় না। আমার মেয়ে এখন নিজেই চলাফেরা করে। আমরা মনে প্রতিটা মেয়েকে এ রকম প্রশিক্ষণ নেওয়া দরকার। তাদের মনোবল, আত্মবিশ্বাসের জায়গাটা অনেক বেড়ে যাবে।

প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মেয়েদের মধ্যে একটি নতুন সমাজ তৈরি হয়েছে। সেখানে মেয়েরা একে অন্যের সুখ-দুঃখের কথা ভাগাভাগি করছে। শুধু তা-ই নয়, যেকোনো সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়েও পরিকল্পনা আঁকছে। বয়সে সবাই অসমবয়সী হলেও পাওয়ারপাঞ্চে প্রশিক্ষণে তারা হয়ে উঠেছে একে অপরের বন্ধু।

রেজওয়ানুল হক, প্রশিক্ষক

উই ফর দেমের প্রতিষ্ঠাতা জীবন ঘোষ বলেন, সম্প্রতি ধর্ষণের প্রবণতা, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কার্যকলাপ বেড়েই চলছে, যা মেয়েদের আত্মবিশ্বাস আর অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে। প্রতিবাদ হিসেবে সবাই ধর্ষণ-নিপীড়নবিরোধী মিটিং-মিছিলেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তাই আত্মরক্ষার্থে কোনো কিছু করা যায় কি না, এমন ভাবনা থেকেই পাওয়াপাঞ্চ প্রকল্প। এই উদ্যোগে এগিয়ে আসে ফ্রিডম মার্শাল আর্ট একাডেমি এবং আইজিএস।

জীবন ঘোষ জানান, এ প্রকল্পে মূলত মেয়েদের বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে নিজের আত্মরক্ষা ও আত্মবিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার কৌশল শেখানো হয়। অনলাইন ও অফলাইন রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে এতে প্রায় ১৫০ জন প্রশিক্ষণার্থী অংশগ্রহণ করেছে। বিনা কোর্স ফিতে চারটি ব্যাচে দেড় মাসে পাঁচটি ক্লাস নেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে পাওয়ারপাঞ্চের মূল প্রশিক্ষক রেজওয়ানুল হক জানান, তিনিসহ আরও চারজন সহকারী প্রশিক্ষক মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। মেয়েরা এখন আত্মরক্ষার কোর্সটি করে অনেকটা সাহসী। এখন তারা বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে জানে এবং এর প্রয়োগ করতে পারবে। কোর্স প্রায় শেষের দিকে।

রেজওয়ানুল জানান, প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মেয়েদের মধ্যে একটি নতুন সমাজ তৈরি হয়েছে। সেখানে মেয়েরা একে অন্যের সুখ-দুঃখের কথা ভাগাভাগি করছে। শুধু তা-ই নয়, যেকোনো সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়েও পরিকল্পনা আঁকছে। বয়সে সবাই অসমবয়সী হলেও পাওয়ারপাঞ্চে প্রশিক্ষণে তারা হয়ে উঠেছে একে অপরের বন্ধু।

এনএ