উত্তরের জেলাগুলোয় চলছে আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের উৎসব। মাঠের পর মাঠজুড়ে পাকা ধানের সোঁদা গন্ধ বাতাসে ভাসছে। ভোরের কুয়াশামাখা রোদের পরশ ছড়িয়ে পড়তেই মাঠে নামের কিষান-কিষানিরা। হিমেল হাওয়ায় নুয়ে পড়া সোনালি ধানের গোড়ায় কাস্তে চালাতে ব্যস্ত কৃষকরা। কোথাও দল বেঁধে, আবার কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে মাঠ থেকে ধান কেটে তোলা হচ্ছে বাড়িতে। আর দিগন্তজোড়া মাঠ ফাঁকা হওয়ার পরপরই ইঁদুরের গর্তে হানা দিচ্ছেন অপেক্ষারত ধানকুড়ানিরা।

কারও হাতে খুন্তি-কোদাল পাচুন, কারও হাতে ব্যাগ কিংবা ডালি। ফসল তুলে নেওয়া খেতে তাদের চোখে খুঁজে ফিরছে ইঁদুরের গর্ত কিংবা পড়ে থাকা ধানের ছড়া। ইঁদুরের জমানো ধানে ভাগ বসাচ্ছেন তারা। খেতে পড়ে থাকে ধানের শিষের মালিকানাও তাদের।

এ দৃশ্য এখন রংপুর জেলার বিভিন্ন মাঠজুড়ে। প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে মাঠে চষে বেড়াচ্ছে ধানকুড়ানি ছোট ছেলেমেয়েরা। কোথাও কোথাও বড়রাও ব্যস্ত ধানের ছড়া কুড়ানোয়।

এবার রংপুর জেলায় আমনের ফলন ভালো হয়েছে। নতুন ধানে ভালো দামের আশায় চাষিরা। বিস্তীর্ণ ধানের খেত ফাঁকা করে গোলা ভরতে কৃষকেরা এখন পুরোদমে ব্যস্ত। কারও কারও ধান কাটা-মাড়াই শেষে বাড়িতে চলছে নতুন ধানের পিঠাপুলি আর পোলাও খাওয়ার আয়োজন।

ব্যতিক্রম শুধু গ্রামে থাকা ভূমিহীন ও গৃহহীন হতদরিদ্র পরিবারের বেলায়। তাদের নিজস্ব জমি নেই কিংবা কোনো জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেননি। তারা থাকেন ধান কাটা-মাড়াইয়ের অপেক্ষায়। যাদের কোনো উৎসব নেই। অন্যের জমির ধান কাটা শেষ হলেই তারা খুশি হন। কারণ, ফাঁকা জমির বুকে ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে থাকে তাদের আনন্দ। কৃষকরা ধান কাটার সময় ধানের ছড়া খেতে পড়ে থাকে। ওই ধানের ছড়া এলাকার হতদরিদ্র ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের শিশুরা কুড়িয়ে নেয়।

গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ দিনমজুর ও দরিদ্র পরিবার কৃষিকাজ করে মজুরি বাবদ ধান অথবা কাজের বিনিময়ে টাকা পায়। যা দিয়ে পিঠা, পুলি, পোলাও করে খায়। কিন্তু কিছু সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্র পরিবার আছে, যারা পিঠা-পোলাও খাওয়ার আশায় ইঁদুরের সংগ্রহ করা খাবার খুঁজে বেড়ায়। এতে তাদের সন্তানের পিঠা-পোলাও খাওয়ার আবদার পূরণ হয়।

সরেজমিনে গঙ্গাচড়া উপজেলার দক্ষিণ কোলকোন্দে কয়েকজন শিশুকে ধান কুড়াতে দেখা যায়। পরিবারে উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় ওই শিশুরা মায়ের পরামর্শে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করছে। একই এলাকার ভূমিহীন ভ্যানচালক সুমন মিয়ার ছেলে, কৃষিশ্রমিক মন্তাজের স্ত্রী আমিনা, বিধবা মহিমা, ভিক্ষুক বাদশা মিয়ার স্ত্রী মনি বেগমও ব্যস্ত গর্ত খুঁড়ে ধানের খোঁজে। শিশুরা দল বেঁধে ছুটে যাচ্ছে মাঠে। তারা গর্তে হানা দিয়ে বের করে আনছে ধানের শিষ। এ সময় তাদের কারও দম ফেলার ফুসরত নেই। সারা গায়ে লেগে থাকে কাদামাটি। তবে তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তাদের।

ধানকুড়ানিদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, মাঠের ধান কেটে নিয়ে যাওয়ার পর অনেক ধানের ছড়া পড়ে থাকে। ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে তারা ধান বের করে আনেন। কেউ আবার পরিত্যক্ত খেতের নারার সঙ্গে থাকা ধান কুড়ান। এই মৌসুমে ইঁদুরের গর্তই তাদের জন্য আশীর্বাদ বলে জানান তারা।

ধান কুড়িয়ে কী করবে, জানতে চাইলে শিশু রুবেল বলে, আমরা সব ধান একসঙ্গে জমা করে বিক্রি করব। ওই টাকা দিয়ে নতুন জামা কিনব। বাড়িতে পিঠা-পোলাও খাব। আরেক শিশু তারিফ হাতে বস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেও ব্যস্ত ইঁদুরের গর্তের খোঁজে। ১২ বছর বয়সী তারিফ গত বছরও ধান কুড়িয়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে মিঠাই-মন্ডাসহ বাহারি খাবার কিনেছিল। এবার জমানো ধান বিক্রির টাকায় স্কুলব্যাগ কিনবে সে।

শুধু ইঁদুরের গর্ত থেকে নয়, কৃষক জমি থেকে ধান আনার সময় পড়ে যাওয়া ধানের শিষ কুড়ান তারা। ইঁদুরের গর্তের ধান ও কুড়ানো ধানের শিষেই এসব পরিবারের মাঝে পিঠা-পোলাও খাওয়ার আনন্দ দেয়। কৃষক স্বপন মিয়া বলেন, আমাদের ধান কাটার পরে নারার সঙ্গে দু-এক গোছা ধান থাকলে সেগুলো তারা কুড়িয়ে নেয়। এ ছাড়া গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের নারী-বধূ ও ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ধান কুড়ায়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, কৃষকরা ধান কাটার সময় ধানের ছড়া খেতে পড়ে থাকে। ওই ধানের ছড়া এলাকার হতদরিদ্র পরিবারের শিশুরা কুড়িয়ে নেয়। তবে ধানের খোঁজে ইঁদুরের গর্তে হাত দেওয়া নিরাপদ নয়। গর্তে সাপসহ বিষাক্ত কিছু থাকতে পারে। আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষকরা খেতের ধান কাটলে মাঠে ধান পড়ে থাকবে না। এতে কৃষকরাও উপকৃত হবেন।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় প্রায় ৬ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিবছর আমন মৌসুমে উৎপাদিত ফসলের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ইঁদুরের পেটে চলে যায়। শুধু আমন মৌসুমে মোট উৎপাদনের ৬ শতাংশ ইঁদুরের খাবারে পরিণত হয়। এভাবে প্রতি মৌসুমে গমের মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশ, আলুর ৬ শতাংশ, শাকসবজির ৫ শতাংশ, নারকেলের ১০ শতাংশ ও আনারসের ১০ শতাংশ ফলন খেয়ে ফেলে ইঁদুর।

এনএ