মেয়ে রুবাইয়ার সঙ্গে রুবেল মিয়া

রুবেল মিয়া। বয়স ৩০ বছর। মাত্র দেড় বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মা-বাবার মৃত্যু হয়। কোনো রকমে ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান তিনি। মা-বাবার মৃত্যুর পর তার আশ্রয় হয় বাবার চাচাতো বোনের বাসায়। অভাব ও দারিদ্র্যের মধ্যেও চাচাতো ফুফুর আশ্রয়ে বেড়ে ওঠেন। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করার পর অনার্সে ভর্তি হন গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে। হঠাৎ ফুফুর মৃত্যুতে থমকে যায় তার সব কিছু। ড্রাইভিং শিখে চালকের চাকরি নেন রুবেল।

 ২০১৯ সালে আঁখি আক্তার নামে এক তরুণীকে বিয়ে করে ঘর বাঁধেন। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে রুবেল-আঁখি দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম নেয় একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান। নাম রাখেন রুবাইয়া। মেয়ের জন্মের তিন দিন পরই স্ত্রী আঁখি আক্তারের মৃত্যু হয়। এবার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন রুবেল। গাজীপুরের শ্রীপুরে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে মেয়েকে বড় করতে থাকেন। মাসিক বেতনে একজন গৃহপরিচারিকা রাখেন। সংসার যেন শুধু বাবা ও মেয়ের। বাবার হাতে গোসল, বাবার হাতে খাওয়া, বাবার কোলে ঘুম শিশুটির সবই ছিল বাবাকে ঘিরেই। মায়ের শূন্যতাও যেন বাবাই ভুলিয়ে দিয়েছিল। 

গত মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) দুপুরে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাবা বিছানায় ঘুমাচ্ছিলেন। আর মেয়েটি খেলছিল ঘরের ভেতর। হঠাৎ করেই বাবার চোখের আড়াল হয়ে যায় রুবাইয়া। একটি জামা হাতে ঢুকে পড়ে গোসলখানায়। সেখানে জামাটি ভেজাতে গিয়ে উল্টে গামলার পানিতে ডুবে করুণ মৃত্যু হয় রুবাইয়ার। রুবেল তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে এখন শোকে স্তব্ধ। এখন কী নিয়ে বাঁচবেন তিনি। প্রতি মুহূর্তে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাকে।  

রুবেল মিয়া ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ গ্রামের মৃত আব্দুল হেকিম ও হালিমা বেগম দম্পতির একমাত্র সন্তান। বর্তমানে থাকেন গাজীপুরের শ্রীপুরের মুলাইদ গ্রামে। একের পর এক স্বজন হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি। নিজের মনের অব্যক্ত কথাগুলোও যেন প্রকাশ করতে কষ্ট হয় তার। 

রুবেল মিয়া বলেন, ছোটকালে বাবা-মায়ের ভালোবাসা কী রকম তা টের পাইনি। যখন বড় হলাম তখন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। অনেক স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে ভালো কোনো চাকরি করব। অভাব ঘুঁচিয়ে সংসার পাতব। অভাবের কারণে স্নাতক শেষ করতে পারিনি। পরে একটি সময় এসে বিয়ে করে সুখের সংসারের স্বপ্ন দেখেছিলাম। তাও মেলাতে পারিনি নিজের ভাগ্যের সঙ্গে। 
দুনিয়াতে আসার পর মা-বাবা, পরে স্ত্রী, সর্বশেষ সন্তান চলে যাওয়ায় এখন যেন হৃদয় শূন্য হয়ে গেছে। বারবার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে ফেলে আসা দিনের স্মৃতিগুলো। এখন আমার কোনো কাছের স্বজন বলতে কেউ নেই। কাকে নিয়ে বাঁচব? 

তিনি বলেন, গত ২৩ মাস ধরে মা হারা মেয়েকে বড় করতে কত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি তার হিসেব নেই। শত কষ্ট মিলিয়ে যেত মেয়ের একটু হাসিতেই। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর অনেকেই বিয়ের পরামর্শ দিয়েছিল। তবে সৎ মা মেয়েকে কীভাবে নেবে এটা ভেবেই বিয়ে করিনি। মেয়ের বাবা ও মা একাই হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস সব শেষ হয়ে গেল। 

শ্রীপুরের মাওনা গ্রামের মো. নাইম মিয়া বলেন, রুবেল দীর্ঘদিন ধরেই আমার গাড়ি চালান। তিনি খুবই বিনয়ী ও ভদ্র। একজন সন্তানের জন্য বাবার কী পরিমাণ ভালোবাসা থাকে তা প্রায় দুই বছর ধরে দেখেছি। মেয়েটিকে হারিয়ে রুবেল এখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আসলে বাবা ও মেয়ের ভালোবাসা সবকিছুর চেয়ে ব্যতিক্রম।

শিহাব খান/আরএআর