পুলিশ তদন্তে স্থায়ী আবাস না পাওয়ায় চাকরি নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হওয়া আছপিয়া ইসলাম কাজলের ‘ভূমিহীন’ হওয়ার গল্পটি জানিয়েছেন তার চাচা মোশারেফ হোসেন মাতবর। 

তিনি জানান, আছপিয়ার মা-বাবা পরিবারের অমতে বিয়ে করায় মূলত দূরত্বের সৃষ্টি হয়। আছপিয়ার বাবা মৃত শফিকুল ইসলাম ছিলেন জেদি প্রকৃতির মানুষ। সে কারণে তিনি লড়াই করে পরিবারে ফিরে যাননি। তাছাড়া আছপিয়ার দাদার আট সন্তানের জন্য যে জমি বর্তমানে রয়েছে ভাগ বাটোয়ারার পর ১০ শতাংশেরও কম পাবেন আছপিয়ার ভাই-বোন।

আছপিয়া ইসলাম স্বীকার করেছেন ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার আমিনাবাদ ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের মকবুল হোসেন মাতবর তার দাদা এবং ব্যবসায়ী মোশারেফ হোসেন মাতবর তার আপন চাচা।

মোশারেফ হোসেন শনিবার (১১ ডিসেম্বর) সকালে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা মরহুম মকবুল হোসেন মাতবর ব্যবসায়ী ছিলেন। আমরা আট ভাই-বোন। এর মধ্যে ছয়জন ভাই ও দুই বোন। ছয় ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই আমির হোসেন মাতবর ছিলেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রকৌশলী এবং তারপরের জন হেলাল উদ্দিন মাতবর ছিলেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের থানা ইঞ্জিনিয়ার। এরপর আমি। তারপর আছপিয়ার বাবা মৃত শফিকুল ইসলাম। এরপরের ভাই অহিদুল ইসলাম মাতবর। সবার ছোট ছিলেন মৃত নিজাম মাতবর। এছাড়া আরও দুই বোন আছে আমাদের।

মোট জমি কত আছে?

মোশারেফ হোসেন মাতবর বলেন, আমার বাবার মোট তিন কানি জমি ছিল। তবে বড় ভাই আমির হোসেন ও মেজ ভাই হেলাল উদ্দিনকে লেখাপড়া করাতে গিয়ে ফসলি সব জমি বিক্রি করে দেন। শেষে বাড়িতে ৬৪ শতাংশ জমি রয়েছে আট ভাই-বোনের জন্য। এর মধ্যে আছপিয়ার বাবার ভাগে পড়েছে ১০ শতাংশ যা থেকে পুকুর, কবরস্থান, হাঁটারপথের জমি বাদ দিয়ে ১০ শতাংশেরও কম পাবে। এই ১০ শতাংশেরও কম জমি মৃত শফিকুলের তিন মেয়ে এক ছেলে পাবে।

তিনি আরও বলেন, ওরা বাড়িতে খুব একটা আসে না। সর্বশেষ পাঁচ মাস আগে ঝরনা বেগম (আছপিয়ার মা) এসেছিলেন বড় ভাবির মৃত্যুতে। এক বছর আগে মেজ ভাবির মৃত্যুতে আরেকবার এসেছিলেন। এছাড়া শফিকুল বেঁচে থাকতে এক-দুই বছর পরপর ১-২ দিনের জন্য বাড়িতে আসত।

কেন এই দূরত্ব?

মোশারেফ হোসেন মাতবর বলেন, আমার বড় ভাই আমির হোসেন মাতবর তখন হিজলা উপজেলা গণস্বাস্থ্য প্রকৌশলী। সেখানে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে শফিকুল থাকত। ১৯৯০ কিংবা ১৯৯১ সালে বড় ভাই বদলি হয়ে পিরোজপুরে যান। সেখানে তার বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত ঝরনা বেগম। ঝরনা বেগমের বাড়ি পিরোজপুর সদরেই। ওই বাসায় থেকে শফিকুল ও ঝরনার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা দুজনে পালিয়ে হিজলা চলে গিয়ে বিয়ে করে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের পরিবার চরফ্যাশনের প্রভাবশালী না হলেও বেশ সম্মানিত ছিল। সেখানে ভাই বড় ভাইয়ের বাসার কাজের মেয়েকে বিয়ে করেছেন, বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি পরিবার। আমার বাবা মেনে নিলেও শেষ পর্যন্ত আমি মেনে নিতে পারিনি। তখন আমি শফিকুলকে বাড়িতে উঠতে বাঁধা দেই। এই থেকেই মূলত দূরত্ব তৈরি হয়। ওরা ‘এক ধরনের ভূমিহীন’ হয়ে পড়ে। 

এরপর শফিকুল হিজলা বাজারে মেজবাহ উদ্দিন অপু চৌধুরীর সমিল, রাইচ মিলে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করত। ২০১৯ সালের প্রথম রমজানের দিন রাতে মারা যায় শফিকুল। শফিকুল মারা যাওয়ার পর ঝরনা বা ওর সন্তানদের প্রতি এখন আর কোনো রাগ নেই। আমার রাগ তো ছিল ভাইয়ের ওপর। এখন সর্ম্পক স্বাভাবিক। তবে ওরা বাড়িতে তেমন আসে না বা যোগাযোগও তেমন নেই। এখনও অপু চৌধুরীর বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকে বলে শুনেছি।

শফিকুল ইসলাম ও ঝরনা বেগমের প্রেমের বিয়ের সত্যতা স্বীকার করেছেন হিজলা উপজেলার বড়জালিয়া ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ঝন্টু বেপারীও। বাজারের আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, বড় ভাইয়ের বাসার কাজের লোক বিয়ে করার পর হিজলা ফিরে এসে শফিকুল অত্যন্ত পরিশ্রম ও সততার সঙ্গে জীবন কাটিয়েছেন। ২০১৯ সালে বাজারের কাছেই জমি কেনার জন্য কথা ঠিক হয়েছিল। টাকা জমা দেওয়ার কয়েকদিন আগেই হঠাৎ মারা যান শফিকুল।

চরফ্যাশন উপজেলার আমিনাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আছপিয়াদের দাদার বাড়ি ২ নম্বর ওয়ার্ডে। ওর বাবা মারা গেলে তাকে এখানেই কবর দেওয়া হয়। শফিকুল বিয়ে করে হিজলাতেই থেকে যান। খুব একটা বাড়িতে আসতেন না। তবে লোক ভালো ছিলেন।

এ বিষয়ে হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বকুল চন্দ্র কবিরাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) আছপিয়া ও তার মাকে নিয়ে জমি দেখানো হয়েছে। তবে জমি হস্তান্তর করা হয়নি, প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

তাদের নামে চরফ্যাশনে জমি আছে এমন তথ্যের বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ তদন্তে উঠে এসেছে হিজলায় তারা ভূমি মালিক নন। এখন কোথাও জমি আছে এমন তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেলে সরকারি জমি ও ঘর হস্তান্তর করা যাবে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এসপি