কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর ও নদীর চর-অধ্যুষিত উপজেলাগুলোর ফসলের মাঠে মাঠে এখন সরিষা ফুলের স্বর্গরাজ্য। সেই রাজ্যে মৌমাছির মিছিলে মুখর হলুদ দিগন্ত। যতদূর চোখ যায় কেবল হলুদ আর হলুদ। চারদিকে হলুদ গালিচা বিছিয়ে যেন অপরূপ সাজে সেজেছে পল্লিপ্রকৃতি। ধীরে ধীরে বেলা গড়িয়ে নেমে আসে বিকেল। সেই বিকেলের কন্যা-সুন্দর আলোয় হলুদ ফুলগুলো রূপ নেয় অন্য এক মাধুর্যে। মিষ্টি বাতাসে দোল খেতে থাকে ফুলের ডগাগুলো। দিগন্ত বিস্তৃত সর্ষের হলুদ ফুল-ফলে সেজে ওঠা সৌন্দর্যে মুগ্ধ কৃষকের চোখে-মুখে তাই নির্মল আনন্দের ঝিলিক।

প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করে ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে কৃষকরা অল্প সময় ও খরচে উৎপাদিত বেশি দামে বিক্রিযোগ্য ফসল সরিষা ব্যাপক হারে চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

ফসলের বাম্পার ফলনের হাতছানিতে হাসি ফুটেছে চাষিদের মুখে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, অন্তর্বর্তী সময়ে চাষ করে উপযুক্ত দাম পাওয়ায় কৃষকরা অধিক হারে সরিষা আবাদের দিকে ঝুঁকছেন। তবে এবার ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে মাথায় হাত কৃষকদের। তারা বলছে, এ কারণেই এবার সরিষায় লাভ কম হবে। সার ও কীটনাশক যদি সরকার বিনামূল্যে বা ভর্তুকি দিতো তাহলে চাষাবাদে আরও লাভবান হাওয়া যেত।

জানা গেছে, প্রতিবছর কার্তিক মাসের শেষের দিকে চাষ হয় সরিষা। পৌষ মাসের মাঝামাঝি সময়ে এর কর্তন হয়। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলে বোরো ফসল কাটা শেষে নিম্নাঞ্চলের জমিগুলো পানির নিচে তলিয়ে যায়।

কার্তিক মাসের দিকে পানি সরে গিয়ে আরেকটি বোরো ফসলের মৌসুম শুরুর মাঝখানের সময়টাতে চাষ হয় সরিষা। এ জন্য চাষিরা এ ফসলটিকে ‘ফাউ’ ফসল হিসেবে বিবেচনা করেন।

বাজারে বিক্রির আগেও এ ফসলের ফুল দিয়ে মুখরোচক বড়া ও পাতা দিয়ে মজাদার শাক রান্না করা হয়। এ ছাড়া কাটা শেষে সরিষাগাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এসব বিক্রি করেও মেলে বাড়তি অর্থ।

বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হয় সরিষা। কৃষকরা ধানসহ অন্যান্য খাদ্যশস্যের উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় ব্যাপক হারে সরিষা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

দেশের অন্যতম সরিষা ফসল উৎপাদনকারী হাওর-অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জ জেলার ফসলের মাঠে মাঠে এখন হলুদ সরিষা ফুলের হাসি। যেদিকেই তাকাই, মনে হয় হলুদ রঙের গালিচায় ছেয়ে আছে এখানকার মাঠঘাট। এ নয়নাভিরাম দৃশ্য ভিন্ন রকম দোলা দিয়ে যায় গ্রামবাংলার মানুষের মনে।

তাই কাব্য ও সাহিত্যে হেমন্ত প্রকৃতিবন্দনায় উপমা হয়ে উঠে আসে সরিষা ফুলের নাম। প্রকৃতির এ মনোলোভা সৌন্দর্য উপভোগে সরিষা ফসলের মাঠে ভিড় জমে প্রকৃতিপ্রেমীদের।

সরেজমিন কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলা তাড়াইল-সাচাইল ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ সরিষা মাঠ পরিদর্শনকালে কথা হয় গ্রামের কৃষাণী সয়ফুল খাতুনের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরিষা ফসলটি খুব ভালো। ফুল দিয়ে বড়া বানানো যায়। শাখ খাওয়া যায় এবং ভালো দামে বিক্রি করে কিছু পয়সা পাওয়া যায়।

আরেক কৃষাণী আসমা খাতুন বলেন, আমারা গরিব কৃষক। ধান চাষ করে ন্যায্য মূল্য পাই না। সরিষা চাষ করেছি, এটা ফসলের ফাঁকে চাষ করা হয়েছে। এটি বিক্রি করে কোনো মতে আমাদের সংসারটা চলবে।

সরিষার ফসলে মাঠ ঘুরতে আসা গ্রামের কিশোর মনির, সাইমন ও আবুল হাসেনের সঙ্গে কথা হলে তারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরিষা ফুল যখন ফোটে তখন হলুদ গালিচার মতো দেখা যায়। অনেক সুন্দর লাগে তাই আমরা আসছি ছবি তোলার জন্য। 

কৃষক কাশেম আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবার ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। তাই ফলন ভালো হলেও লাভের আশা কম।

আরেক কৃষক আহাদ উল্লাহ বলেন, অন্য অনেক ফসল চাষ করে লাভ কম হয় তাই আমাদের এলাকার অনেকেই সরিষা চাষ করে। সরিষা চাষে তেমন খরচ হয় না। তাই এটা থেকে অনেক আয় করা যায়। যা দিয়ে অন্য ফসলের খরচ ও সংসারে কিছু খরচও চলে। তবে সরকার যদি বিনামূল্যে বা ভর্তুকি দিয়ে বীজ, সার ও কীটনাশক দিত তাহলে আমাদের খুব ভালো হতো।

কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. ছাইফুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর কিশোরগঞ্জ জেলায় ৭ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ হাজার ৮১৫ মেট্রিক টন। তবে বাম্পার ফলনের হাতছানি থাকায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশাবাদ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এই কর্মকর্তার।

এসকে রাসেল/আরআই