মাঝেমধ্যে না খেয়েই দিন কেটে যায় আমাদের
বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও চার শিশু সন্তান। পরিবারে সাত সদস্যের বসবাস। গাছ থেকে পড়ে কোমর ভেঙে যাওয়ার পর প্রতি রাতেই হাড় ভাঙার তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করেন জিয়া শেখ (৪২)। তীব্র ব্যথায় তার গোঙানির শব্দ শুনে অসহায়ের মতো মুখের দিকে চেয়ে থাকে তার চার শিশুসন্তান। কারোর সাহায্যে কারও এগিয়ে আসার সুযোগ নেই। কারণ, এক পরিবারে পাঁচজনই শারীরিক প্রতিবন্ধী।
ফরিদপুরের মধুখালীর হতদরিদ্র জিয়া শেখের পরিবারের করুণ কাহিনি এটি। জিয়ার বাবা করিম শেখ ছিলেন একজন হতদরিদ্র। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে ভিক্ষা করে চলত সংসার। ২০১৪ সালে তিন ছেলে ও স্ত্রী রেখে মারা যান করিম শেখ। ছোট ছেলে জিয়া একজন শ্রবণপ্রতিবন্ধী। ভূমিহীন এই পরিবারের মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই ছিল না।
বিজ্ঞাপন
এই যখন অবস্থা, তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা নেমে আসে জিয়ার জীবনে। তিনি দিনমজুরির পাশাপাশি তালগাছ ও নারকেলগাছ পরিচর্যার কাজ করে সংসার চালাতেন। ছয় মাস আগে একটি তালগাছের ডগা পরিষ্কার করতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে আহত হন জিয়া। পরে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু চলাচলের শক্তি হারান তিনি। পরে চিকিৎসক বলেছেন, অপারেশন করাতে হবে। কিন্তু সেই অপারেশন করানোর আর্থিক সামর্থ্য নেই তার পরিবারে।
জিয়ার স্ত্রী আরজিনা বেগম (৩৫) শ্রবণপ্রতিবন্ধী। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে তাদের সংসারে। এর মধ্যে বড় ছেলে আকাশ (১৪) জন্ম থেকেই শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। পাঁচ বছর বয়সী ছোট মেয়ে ইয়াসমিন মা-বাবার মতোই শ্রবণপ্রতিবন্ধী। ১৩ বছর বয়সী বড় মেয়ে হেলেনা সুস্থ-স্বাভাবিক। সে এখন মেগচামী আদর্শ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আরেক ছেলে ৮ বছর বয়সী তামিম শেখ স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র।
বিজ্ঞাপন
চরম অভাব আর দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত পরিবারের একটু খাবারের জোগান দিতে আরজিনা বেগম স্থানীয় একটি কারখানায় মজুরের কাজ নেন। কিন্তু কারখানার কাজ বেশ কঠিন ও ভারী হওয়ায় তিনি তা করতে পারছিলেন না। শেষে কাজ ছেড়ে ফিরে আসেন ঘরে। এখন তিনিও বেকার।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অর্থাভাবে জিয়ার পরিবারে এখন করুণ দশা চলছে। একমাত্র উপার্জনকারী জিয়া শেখ এখন চলাফেরা করেন লাঠিতে ভর দিয়ে। কাঁচামাটির ভিতে টিনের দোচালা একটি ঘর তুলে সেখানেই বসবাস করছেন সাত সদস্য নিয়ে। জিয়া শেখের মা রিনা বেগম ষাটোর্ধ্ব। তিনিও একজন শ্রবণপ্রতিবন্ধী।
সরেজমিনে গেলে জিয়া শেখ জানান, বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা ব্র্যাক থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া গরু পালন করে বিক্রির পর সেই টাকা দিয়ে গ্রামে ৩ শতাংশ জমি কিনেছেন। সেখানে কোনোমতে একটি ঘর তুলে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। শুধু বড় ছেলে আকাশ প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। এ ছাড়া মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে চলতে হয় তাদের। কেউ না দিলে মাঝেমধ্যে চুলাও জ্বলে না। শিশু সন্তানদের ঠিকমতো খাবার না দিতে ব্যর্থ পরিবার।
জিয়া শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি, আমার মা, দুটি সন্তান ও স্ত্রী মিলে পরিবারে পাঁচজন প্রতিবন্ধী। আমার আয়রোজগার করে তাদের খাওয়ানোর কথা থাকলেও আমি ঘরে পড়ে আছি বেকার। কাজ করার মতো পরিস্থিতি নাই আমার। খুব কষ্টে আমাদের দিন কাটছে। মাঝেমধ্যে না খেয়েই দিন কেটে যায় আমাদের।
সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য আজম মোল্যা বলেন, হতদরিদ্র পরিবারটি খুবই অসহায়ত্বের মধ্যে রয়েছে। আমরা এলাকাবাসী টাকা তুলে জিয়া শেখের চিকিৎসা করিয়েছি। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। এখন জিয়াকে উপার্জনক্ষম করে তুলতে হলে তার কোমরের চিকিৎসা করাতে হবে। কিন্তু টাকা জোগানের সামর্থ্য নেই পরিবারের।
মধুখালী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা কল্লোল সাহা বলেন, জিয়া শেখের বড় সন্তান সরকারি প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। বাকিদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি বিশেষ যে প্রতিবন্ধী ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা আছে, সেটিও এই পরিবারের জন্য আমরা ব্যবস্থা করব।
এনএ