ভারত সীমান্তঘেঁষা উঁচু-নিচু পাহাড় বেষ্টিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি গজনী অবকাশ। করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ সময় থমকে ছিল আকর্ষণীয় এই পর্যটনকেন্দ্রটি। এবার ভ্রমণপিপাসুদের নজর কাড়তে নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিয়েছে শেরপুর জেলা প্রশাসন। 

এরই ধারাবাহিকতায় ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে গজনী অবকাশে নির্মিত হয়েছে ঝুলন্ত সেতু, জিপ লাইনিং ও ক্যাবল কার। যেখানে ঝুলন্ত ব্রিজ দিয়ে পাহাড়ের এক টিলা থেকে আরেক টিলায় যাতায়াত করতে পারবেন পর্যটকরা। ক্যাবল কারে চড়েও উপভোগ করতে পারবেন দুই পাহাড়ের মধ্যকার অনাবিল সৌন্দর্য।

ব্যবসায়ী আব্দুর রশীদ বলেন, ঝুলন্ত ব্রিজ, জিপ লাইনিং ও ক্যাবল কার গজনী অবকাশে নতুন মাত্রা যোগ করল। নিচের লেকগুলো পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। জেলা প্রসাসন থেকে সেটাও ঠিক করা হয়েছে। দীর্ঘ দিন পর করোনা কাটিয়ে উঠেছে দেশ। তাই আমরা আশাবাদী এবার গজনী অবকাশে বিপুল পর্যটক আসবে। আমরাও গত দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে ভালো ব্যবসা করতে পারব।

গজনী অবকাশে ঘুরতে আসা রহিমা খাতুন জানান, অনেক মজা করলাম। পাহড়ে ঘুরলাম, কেনাকাটা করলাম। এখন গজনী অবকাশে নতুন কিছু যোগ হয়েছে। নতুর রূপে ফিরেছে গজনী।

জেলা প্রশাসকের সহধর্মিণী জান্নাতুল ফেরদৌস প্রিয়া জানান, মাত্র ছয় মাসের মধ্যে তিনটি রাইডের কাজ শেষ হয়েছে। এবার গজনীতে আন্তর্জাতিক মানের জিপ লাইনিং ও ক্যাবল কার নির্মিত হয়েছে। পার্বত্য জেলা রাঙামাটির আদলে তৈরি করা হয়েছে ঝুলন্ত সেতু। আমার মনে হয় এবার পর্যটনপ্রেমীরা গজনীতে আসতে কার্পণ্য করবে না। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ জানাই।

জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশিদ ঢাকা পোস্টকে জানান, মাত্র ছয় মাস আগে শেরপুর জেলার দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। ভারত সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ে গজনী অবকাশ কেন্দ্রটি করোনার কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সংস্কারের অভাবে বিভিন্ন স্থাপনা ছিল বেহাল অবস্থায়। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করেছেন। তাই এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অন্য দেশের অনুকরণে তিনটি রাইড নির্মাণের প্রস্তুতি গ্রহণ করি।

তিনি আরও বলেন, মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসব রাইডের উদ্বোধন করতে পেরে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। গজনীর লেকে কটেজ, ফিশিং ও কায়াকিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে, এগুলোর প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। 

তিনি বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তা বাড়াতে ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন মহলে টুরিস্ট পুলিশ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। আপাতত আমরা স্থানীয়ভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা রেখেছি। এগুলোর মাধ্যমে শেরপুরের পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ হবে। এর ফলে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনেক পর্যটক আসবে।

এছাড়া গজনীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য একটি কালচারাল সেন্টার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যারা গরিব, অসহায় সংস্কৃতিমনা তারা কালচারাল সেন্টার থেকে আয় করতে পারবে। সেইসঙ্গে ঝিনাইগাতি উপজেলার রাংটিয়া এলাকায় পর্যটকদের রাতযাপনের জন্য একটি মোটেল নির্মাণ করা হবে। জামালপুরের বকশিগঞ্জ, শেরপুরের শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতি, নাকুগাঁও সীমান্ত সড়ক দিয়ে যারা যাতায়াত করেন তারা এই মোটেলে রাত্রিযাপন করতে পারবেন। ইতোমধ্যে এই বিষয়ে পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমি কথা বলেছি।

উল্লেখ্য, পাহাড়, বন, ঝরনা, হ্রদ এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেও কৃত্রিম সৌন্দর্যের অনেক সংযোজনই রয়েছে গজনীতে। বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বেশ কিছু স্থাপনা ও ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। গজনীর প্রবেশমুখে মৎস্যকন্যা (জলপরী) আপনাকে স্বাগত জানাবে, তারপর রয়েছে ডাইনোসরের বিশাল প্রতিকৃতি, ড্রাগন ট্যানেল, দণ্ডায়মান জিরাফ, পদ্ম সিঁড়ি, লেকভিউ পেন্টাগন, হাতির প্রতিকৃতি, স্মৃতিসৌধ, গারো মা ভিলেজ, ওয়াচ টাওয়ার, নিকুঞ্জ বন ও আলোকের ঝরনা ধারা। আগে ছোট পরিসরে একটি চিড়িয়াখানা থাকলেও নতুন করে এতে সংযুক্ত করা হয়েছে মেছো বাঘ, অজগর সাপ, হরিণ, হনুমান, গন্ধগোকুল, সজারু, কচ্ছপ, বাজপাখি, খরগোশ এবং ভাল্লুকসহ প্রায় ৪০ প্রজাতির প্রাণী। 

শেরপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পাহাড়ের বুক জুড়ে তৈরি হয়েছে সুদীর্ঘ ওয়াকওয়ে যেখানে হেঁটে পাহাড়ের স্পর্শ নিয়ে লেকের পাড় ধরে যাওয়া যাবে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। উঁচু পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে মনোমুগ্ধকর জলপ্রপাত। এছাড়া রয়েছে শিশু দর্শনার্থীদের জন্য চুকুলুপি চিলড্রেনস পার্ক। সেখানে এক্সপ্রেস ট্রেনের পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হয়েছে শিশু কর্নার, সুপার চেয়ার, নাগরদোলা ও মেরিগো। 

এছাড়া গজনী অবকাশ কেন্দ্রে রয়েছে ক্রিসেন্ট লেক, লেকের ওপর রংধনু ব্রিজ, কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিফলক, মাটির নিচে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাতায়াতের জন্য ড্রাগন ট্যানেল।

অবকাশকেন্দ্রের অন্যতম আকর্ষণ সাইট ভিউ টাওয়ার। ৮০ বর্গ ফুট উচ্চ এ টাওয়ারে উঠলে দেখা যাবে পুরো গজনী অবকাশের পাহাড়ি টিলার অপরূপ সৌন্দর্য।

জাহিদুল খান সৌরভ/এসপি