থইথই জলে মাঝিমাল্লার বইঠার ছন্দে মেতে ছিল খুলনার রূপসা নদী। কাশি-বাঁশি আর ঝাঁঝরের সুরে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের তালে দর্শনার্থীর করতালিতে মুখর চারপাশ। নৌকার দলনেতা সতীর্থদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ও উৎসাহ জোগান। এমন উৎসব দেখতে নদীর দুই তীরে নামে লাখো জনতার ঢল। সৃষ্টি হয় উৎসবমুখর এক পরিবেশ।

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় কেউ নদীর পাড়ে, কেউ ট্রলারে, নদীর কোল ঘেঁষে থাকা বিভিন্ন উঁচু ভবন ও তার ছাদে। আবার কেউ কেউ নদীতে নোঙরে থাকা লঞ্চ ও ট্রলারে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছেন নৌকাবাইচ।

রূপসা নদীর বুকে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসেছেন সবাই। শিশু, নারী, পুরুষ ও সব শ্রেণি-পেশার মানুষের উপস্থিতিতে অবতারণা হয় রূপসার দুই তীরে। খ্রিষ্টীয় নতুন বছরের শুরুতেই এমন আয়োজনে খুলনার মানুষ আনন্দিত। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় পুলিশ, র‌্যাব, কোস্টগার্ড, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে।

শনিবার (১ জানুয়ারি) রূপসা নদীতে খুলনা জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নগর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এই ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচের আয়োজন করে। নগরীর ১ নং কাস্টম ঘাট থেকে খানজাহান আলী রূপসা সেতু পর্যন্ত এই নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয়। সকালে এই আয়োজনকে ঘিরে মহানগরীতে একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুপুরে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক। দুপুরে রূপসা ১ নং কাস্টম ঘাটে বেলুন উড়িয়ে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাইচ প্রতিযোগিতা শুরু হয়।

খুলনা ও খুলনার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে লাখো লোকের সমাগম লক্ষ করা যায়। নদীর দুই পাড়ে, ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে তারা এই ঐতিহ্যবাহী খেলা উপভোগ করে। এ ছাড়া আরও অনেকে ট্রলার, স্পিডবোটে করে নদীতে ঘুরে দেখেন এই খেলা।

আয়োজকরা জানায়, রূপসার তীরের মানুষের নির্মল বিনোদনের অনুষঙ্গ নৌকাবাইচের ইতিহাস বহু প্রাচীন। আবেগ-উত্তেজনার নৌকাবাইচ হয়ে ওঠে এই অঞ্চলের মানুষের আনন্দের খোরাক। চিরন্তন এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতিবছরের মতো এ বছরও খুলনার রূপসা নদীতে আয়োজিত করা হয় ফানস্টিক ১৪তম খুলনা নৌকাবাইচ।

এবারের নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কার ১ লাখ টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার ৬০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় পুরস্কার ৩০ হাজার টাকা। এ বছর নৌকাবাইচে ১৪টি দল অংশগ্রহণ করে।

বাইচ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে সুন্দরবন টাইগার, নৌকার মালিক আক্তারুজ্জামান বাবু এমপি। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে মাগুরা টাইগার, আকরাম বিশ্বাসের দল। তৃতীয় স্থান অধিকার করে ভাই ভাই জলপরী, তেরখাদার মো. দেদার মোল্লার দল। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নৌকাবাইচ সফল হওয়ায় সহযোগিতার জন্য সব প্রতিষ্ঠানের প্রতি নগর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়।

নৌকাবাইচ দেখতে আসা দিলরুবা লিপি বলেন, বাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা খুলনায় ধারাবাহিকতা বহন করে আসছে। আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। খুব ভালো লাগছে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা দেখতে পেরে।

কয়রার সুন্দরবন টাইগার্স নৌকাবাইচ দলের সদস্য মো. খলিলুর রহমান বলেন, প্রতিবছর রূপসা নদীতে নৌকাবাইচে আমাদের দল অংশ নেয়। প্রতিবারই আমরা চ্যাম্পিয়ন হই। ফলে আমরা খুবই আনন্দিত। আমরা যেন গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারি এবং প্রতিবছরই এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারে, সেই কামনা করি।

নগর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সদস্য অন্তর ও নুশান আহমেদ বলেন, প্রতিবছরের মতো এ বছরও নৌকাবাইচ আয়োজন করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ গ্রামবাংলার এতিহ্যের নৌকাবাইচ দেখতে এসেছে। খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে এ প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ এসেছে উপভোগ করতে।

আনসার সদস্য রহিমা আক্তার মনি বলেন, নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা দেখতে আসা মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব সুশৃঙ্খলভাবে পালন করছি।

নগর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সভাপতি মোল্লা মারুফ রশীদ বলেন, নদীমাতৃক দেশ। নদী বাঁচলে দেশও বাঁচবে। নৌকাবাইচ নিজস্ব সংস্কৃতি। করোনার কারণে গত বছর নৌকাবাইচ করতে পারিনি। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে বছরের শুরুতেই এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছি। সবার সহযোগিতায় নৌকাবাইচ সফলতা পাবে।

তিনি বলেন, কয়রা, সাতক্ষীরা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, নড়াইল, মাগুরা, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, কোটালীপাড়া, শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এবার ২০টিরও অধিক নৌকা অংশগ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু ৬টি নৌকা নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে আসতে পারেনি। ১৪ নৌকা এবারের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।

নগর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আয়োজনে জেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা ও তত্ত্বাবধানে, আকিজ বেকার্স লিমিটেড বিস্কুক ব্র্যান্ড ফানটাস্টিকের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব বর্ষ উপলক্ষে এবারের আয়োজন সকাল ৯টায় শিবাবাড়ী মোড় থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালি শুরু হয়। এটি উদ্বোধন করেন বিভাগীয় কমিশনার মো. ইসমাইল হোসেন।

দুপুরে নগরীর ১নং কাস্টমঘাটে প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় পুরস্কার বিতরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক ও নৌকাবাইচের প্রধান সমন্বয়কারী মনিরুজ্জামান তালুকদার।

উদ্বোধন ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন নগর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সভাপতি মোল্লা মারুফ রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান রহিম। এ সময় বক্তৃতা করেন খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি ড. খ. মহিদ উদ্দিন, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) এসএম ফজলুর রহমান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার সরদার রাকিবুল ইসলাম, খুলনা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ মাহবুব হাসান, ট্যুরিস্ট পুলিশ সুপার দেওয়ান লালন আহমেদ, কেএমপির ডেপুটি পুলিশ কমিশনার রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. ইউসুফ আলী, এডিসি (শিক্ষা ও আইসিটি) সাদিকুর রহমান খান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পুলক কুমার মন্ডল, রূপসা উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন বাদশা, উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবাইয়া তাসনিম, নগর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আল-জামাল ভূঁইয়া, এসএম আকতার উদ্দিন পান্নু, গোলাম রব্বানি ভূঁইয়া, কিশোর কুমার সরকার, বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির নিজাম-উর-রহমান লালু, শাহীন জামান পন, মিনা আজিজুর রহমান ও রওশনা রুবি।

মোহাম্মদ মিলন/এনএ