দেশে তখন যুদ্ধ চলছে। স্বামী রমজান আলী জমিতে কাজ শেষ করে ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। রমজান মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে তারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শহীদ পরিবার হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের মাধ্যমে স্ত্রী মোছা. ইফাতন বেওয়ার (৭৭) কাছে একটি চিঠি পাঠায়।

সেই চিঠিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেখেন, প্রিয় বোন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আপনার পরিবারের সাহায্যর্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের কাছে ২ হাজার টাকার চেক পাঠানো হলো। চেক নং মিত্র ০২১৫২০। আমার প্রাণভরা ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিন। শেখ মুজিব তারিখ ২০.১২.১৯৭২। 

ইফাতন বেওয়া টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বলিভদ্র ইউনিয়নের পানকাতা গ্রামের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদ রমজান আলীর স্ত্রী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সেই চিঠি ৫০ বছর ধরে বুকে আগলে রেখেছেন ইফাতন। এটি শুধু কাগজের চিঠিই নয়, বর্বর পাকিস্তানিদের হাতে নিহত স্বামীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। অনটনের সংসারে অনেক কিছু হারালেও মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর অবদানের স্বীকৃতির সেই চিঠি নিয়ে তিনি আজও গর্ব অনুভব করেন। 

সরেজমিনে পানকাতা গ্রামে দেখা যায়, শহীদ রমজান আলীর স্ত্রী ইফাতন বেওয়া বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বসবাস করছেন জরাজীর্ণ একটি ঘরে। ঘরে কোনো রকম একটি দরজা থাকলেও জানালা নেই। টিনে জং ধরে খসে পড়ছে। ওই ঘরেই নাতনি সুমাকে নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। একমাত্র ছেলে ঢাকায় রংমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি যা উপার্জন করেন তাতে তারই সংসার চলে না।

জানা গেছে, বৃদ্ধা ইফাতনের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে ঢাকায় রংমিস্ত্রির কাজ করেন। প্রথম বিয়ের পর ছেলের ঘরে একটি মেয়েসন্তান হয়। বউ মারা যাওয়ায় ছেলে আবার বিয়ে করেন। তারপর থেকে মায়ের খোঁজ-খবর নেন না। ফলে নাতনিকে নিয়ে বসবাস করেন ইফাতন। নাতনি সুমা এখন দাদির দেখাশুনা করছে। সে পানকাতা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ইফাতনের স্বামী ভালো জমিজমা রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের কারণে বাড়ির জমিটুকু বাদে সব বিক্রি করতে হয়েছে। এখন ১০ শতাংশ জমিতে একটি ভাঙাচোরা টিনের ঘর রয়েছে। তাতে নাতনিকে নিয়ে তিনি বসবাস করছেন।

ইফাতনের স্বামী রমজান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বেচ্ছাসেবক। পাকিস্তানিরা যখন তার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করে তখন তার মেয়ে ছিল গর্ভে। ছেলের বয়স তিন বছর। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পানকাতা গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে বহু মানুষের বসতঘর পুড়ে যায়। পানকাতা গ্রাম যুদ্ধকালীন গোপালপুর উপজেলার অধীনে ছিল। পানকাতা হাইস্কুল ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প। ৩০ সেপ্টেম্বর গোপালপুর থেকে পাকিস্তানি হানাদাররা পানকাতা ক্যাম্প দখল করতে আসে। সেসময় মাহমুদপুর বটতলায় মুক্তি বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার হুমায়ুন বাঙ্গাল পাকিস্তানিদের বাধা দেন। এ সময় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানিরা শুরু করে গণহত্যা।

স্থানীয়রা জানায়, যুদ্ধে স্বামীহারা ইফাতন খুব কষ্ট করে ছেলে-মেয়েকে মানুষ করেছেন। বাড়ির পাশে সরকারিভাবে স্থাপিত একটি টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করেন। সরকারি ভাতা পেলেও তা দিয়ে সংসার চলে না। 

ইফাতনের নাতনি সুমা খাতুন বলে, পড়ালেখার পাশাপাশি আমি দাদির সব কাজ করি। স্কুলে যাওয়ার পরও সুযোগ হলেই দাদিকে দেখতে আসি। আশপাশের অনেকেই সহযোগিতা করে। দাদি অনেক কষ্ট করেছে। এখনও করছে। আমাদের ঘরটি ভাঙা। সরকার একটি ঘর দিলে দাদিকে নিয়ে থাকতে পারব। এছাড়া আমার পড়ালেখাসহ আর্থিক সহায়তা করলে ভালো হতো।

ইফাতনের মেয়ে রমিছা বেওয়া বলেন, পাকিস্তানিরা যখন আমার বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করে তখন আমি মায়ের গর্ভে ছিলাম। যুদ্ধের পর খুব দুঃখে-কষ্টে আমাদের দিন গেছে। এখনো দুঃখ পিছু ছাড়েনি। এসএসসি পাস করার পর আমার বিয়ে হয়। আমার স্বামীও মারা গেছে। সন্তানদের নিয়ে স্বামীর বাড়িতেই থাকি। তবে মাঝেমধ্যে মাকে দেখতে আসি। ভাইয়ের মেয়েই মাকে দেখাশুনা করে। প্রায় দেড় বছর আগে স্ট্রোক করায় এখন আর কথা বলতে পারেন না ঠিকমতো।

ইফাতন বেওয়া বলেন, পাকিস্তানিরা আমার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তখন আমার গর্ভে সন্তান ছিল। খুবই কষ্টে দিন কেটেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ পরিবার হিসেবে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল। সেইসঙ্গে দুই হাজার টাকার একটি চেক। চিঠিটি এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছি। তবে পরবর্তীতে শহীদ পরিবার হিসেবে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি। সহায় সম্বল হিসেবে বাড়ির ১০ শতাংশ জায়গা ছাড়া কিছুই নেই। 

ধনবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসলাম হোসাইন বলেন, শহীদ পরিবারের এমন খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) স্যারসহ আমরা তার বাড়িতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপহার সামগ্রী, নগদ টাকা, শাড়ি ইফাতনের হাতে তুলে দিয়েছি। তার ভাতার কার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার নাতনির জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের যদি মুক্তিযোদ্ধার গেজেট হয়ে যায় তাহলে পাকা ভবন হিসেবে বীর নিবাস নির্মাণ করে দেওয়া হবে।

এসপি