জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। লবণাক্ত অঞ্চলে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা শ্যামনগর উপজেলায় বেসরকারি সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ গড়ে তুলেছে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে হাসপাতাল ভবনের নকশা করা হয়। ২০২১ সালে হাসপাতালের ভবনটি জিতে নিয়েছে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস (রিবা) অ্যাওয়ার্ড।

অল্প খরচে হাসপাতালটিতে চিকিৎসাসেবা পেয়ে খুশি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। এখানে চিকিৎসাসেবা পাওয়া বাসিন্দারা বলছেন, এটি উপকূলের মানুষের জন্য আশীর্বাদ।

কালিগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের বেলেডাঙ্গা গ্রামের সাইদুল ইসলাম ১৫ দিন আগে ইটের ভাটায় শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে কোমরে আঘাত পান। চিকিৎসা নিচ্ছেন ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে। সাইদুল ইসলাম বলেন, ডাক্তার দেখিয়েছি, ফি নিয়েছে মাত্র ১০০ টাকা। চিকিৎসকের পরামর্শে থেরাপি দেওয়া হয়েছে এখানে। থেরাপি ফি নিয়েছে ১৫০ টাকা। ২৫০ টাকায় ভালো চিকিৎসা পেয়েছি। এটি অন্যত্র করাতে গেলে চিকিৎসকের ফি ৫০০ টাকা আর থেরাপির ফি ৫০০ টাকা নিত। গরিব মানুষের জন্য অল্পখরচে ভালো চিকিৎসা হচ্ছে এই হাসপাতালটিতে। 

আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কল্যাণপুর গ্রাম থেকে স্ত্রী লতিফা বেগমকে চিকিৎসার জন্য ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে এনেছেন স্বামী সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, উপকূলে ভালো কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। সাতক্ষীরা অথবা খুলনায় যেতে হয়। এই হাসপাতালটি করে আমাদের জন্য খুব ভালো হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা খরচও খুব কম। অন্য চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে গেলে টাকা ছাড়া কিছুই চিনে না তারা। 
 
জলবায়ুর পরিবর্তনে বিধ্বস্ত উপকূলীয় অঞ্চলে হতদরিদ্র মানুষদের সেবা দানের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে বেসরকারি এনজিও সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রিনা খান হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু করেন। স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুই একর জমির উপর ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে হাসপাতালটি। নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। ২০টি ভবনের সমন্বয়ে ৪১ হাজার ৬৭২ বর্গফুট জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই হাসপাতাল। পর্যাপ্ত আলো বাতাসের জন্য রয়েছে ৪৬ হাজার ১৫০ বর্গফুট ফাঁকা জায়গা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি মাথায় রেখে ভবনটির নকশা করেন স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, বৃষ্টির পানি ধরে রাখা, সেই পানি বিশুদ্ধ করে খাওয়ার ব্যবস্থাসহ আবহাওয়ার গতিপথ বিবেচনা করে ভবনটি তৈরি করা হয়েছে। রোগীদের যেন মনে হয় বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। 

ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের রিসিপশনিস্ট রাশিদুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন ৮০-১০০ আবার কোনো দিন তার ঊর্ধ্বে হতদরিদ্র প্রান্তিক মানুষ এখানে চিকিৎসা সেবা নেন। হাসপাতালটিতে রয়েছে ৫০টি শয্যা। চালু রয়েছে ইনডোর, আউটডোরসহ জরুরিসেবা কার্যক্রম। সার্জারির ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। শুক্রবারসহ ছুটির দিনেও চিকিৎসাসেবা পান রোগীরা। সার্বক্ষণিক রয়েছেন ছয়জন চিকিৎসক, ১২ জন নার্স। অল্প খরচে এখান থেকে চিকিৎসাসেবা পেয়ে খুশি প্রান্তিক মানুষেরা। সব ধরনের রোগীই আসছেন হাসপাতালটিতে।

হাসপাতালের সহকারী মহাব্যবস্থাপক অসীম খ্রীষ্টফার রোজারিও বলেন, ২০১৮ সালে এখানে চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু হয়। ডিজিটাল এক্সরে, ইসিজি, আল্ট্রাসাউন্ড, রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা, মাইক্রো বায়োলজিক্যাল পরীক্ষাসহ সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে এখানে। শুধু শ্যামনগর-সাতক্ষীরা নয়, বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন রোগীরা। বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৪০০-৫০০ জনকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে হাসপাতালটিতে। হাসপাতালের নিজস্ব কর্মী ও অতিথিদের জন্য ৩২টি আবাসন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। 

তিনি বলেন, স্বল্প ব্যয়ে আধুনিক স্থাপত্যশৈলী দৃষ্টিনন্দন ভবনটি গত ২৬ জানুয়ারি (বুধবার) যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস (রিবা) অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। বিশ্বের সেরা ভবনটি এখন সাতক্ষীরায়। এটি শুধু সাতক্ষীরা নয়, বাংলাদেশের জন্য গৌরব বয়ে এনেছে।

হাসপাতালটির স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন উপকূলীয় অঞ্চলে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি মাথায় রেখে ভবনটির নকশা করা হয়েছে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখা, দ্রুত নিষ্কাশন, পরিবেশকে ঠান্ডা রাখা, বাতাসের গতিপথ বিবেচনায় নিয়ে ভবন তৈরি, রোগীদের জন্য প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ সব কিছু বিবেচনায় নিয়েই এটি করা হয়েছিল। আমরা যে ভাবনাগুলোর সমন্বয়ে এটি করেছি, আমাদের সেই চিন্তা-ভাবনাটার তারা স্বীকৃতি দিয়েছেন। হাসপাতালটির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বুঝতে পেরেছেন তারা।

আকরামুল ইসলাম/আরএআর