সচেতনতা ও নৈতিকতার অবক্ষয় থেকে যৌতুক, ধর্ষণ, অপহরণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য।

তিনি বলেন, ২০২১ সালে রংপুর বিভাগের আট জেলায় নারী নির্যাতন মামলা হয়েছে মোট ২ হাজার ৫৩৭টি। এর মধ্যে ১ হাজার ১২৯টি যৌতুক বা স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায়, এমন জটিলতা সংক্রান্ত মামলা। এছাড়া ৮০৪টি ধর্ষণ এবং ৫৮০টি নারী অপহরণ মামলা হয়েছে। সব মিলিয়ে এক বছরে শুধু ধর্ষণ ও নারী অপহরণ মামলা হয়েছে ১ হাজার ৩৮৪টি।

গতকাল বৃহস্পতিবার (০৩ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় ‌‘ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ, রংপুর রেঞ্জ, রংপুর’ নামের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য এসব কথা বলেন। মূলত সন্তানের অপরাধ রুখতে অভিভাবকদের মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভিডিও বার্তাটি প্রকাশ করা হয়েছে।

ভিডিও বার্তায় ডিআইজি বলেন, গত বছর যে ৮০৪টি ধর্ষণ মামলা হয়েছে, তার ৯০ শতাংশই প্রেমঘটিত। পারস্পারিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত না যাওয়ায় ভুক্তভোগী মেয়েরা থানায় অভিযোগ করছে। আর নারী অপহরণের যে ৫৮০টি মামলা, তার প্রত্যেকটি হয়েছে ছেলে-মেয়ের পারস্পারিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে ঘিরে। এসব ঘটনায় মামলা হলে পুলিশ ভিকটিমকে উদ্ধার করছে। অপহরণকারীকে আইনের আওতায় নেওয়া হচ্ছে।

নারী অপহরণের হিসেব বিশ্লেষণ করে দেবদাস ভট্টাচার্য্য বলেন, প্রতি মাসে ৪৮টি এমন ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণ ও অপহরণের হিসেব কষলে একসঙ্গে ১১৫টি ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনাগুলো প্রতিটি পরিবারের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত এবং যন্ত্রণাদায়ক। যার প্রেক্ষিতে তারা পুলিশের শরণাপন্ন হচ্ছেন। পুলিশ তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থাও নিচ্ছে। 

তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে মেয়েরা অল্পবয়সী। এরা ১২ থেকে ২০ বছর বয়সী। জীবনবোধ সম্পর্কে এরা একেবারেই অপরিণত ও অপরিপক্ক। বিভিন্নভাবে প্রলোভনে পড়ে এ কাজগুলো করছে। আমরা তাদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছি। আইনে সোপর্দ করছি এবং অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। আবার অনেক সময় তা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে পুলিশের যে দায়িত্ব, তাই করা হয়।

অভিভাবকদের অসচেতনতা, দায়িত্ববোধের কমতি এবং সন্তানের নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণ থেকেই এমন অপরাধমূলক ঘটনা বাড়ছে বলে দাবি করেন ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য।  

অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি মা-বাবার কাছে তার সন্তান সব চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যা কিছুই করি না কেন, সন্তানের মঙ্গলের জন্য করি। সন্তান যে বড় হচ্ছে, সে কার সঙ্গে মিশছে, তার সঙ্গে কতটুকু ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, সেই খবর কি আমরা রাখি? আপনি হতে পারেন খুব ব্যস্ত মানুষ, আপনার সন্তানকে সময় দেওয়ার সময় নেই। অথবা আপনার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই, যে শিক্ষা দিয়ে আপনি আপনার সন্তানকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। কিন্তু আপনি তো অবশ্যই চান, আপনার সন্তানের যাতে কোনো ধরনের ক্ষতি না হয়, সন্তানটি যেন ভালো থাকে। সেটি যদি আপনি চান, তাহলে আপনার সন্তানের জন্য কিছুটা সময় আপনাকে বের করতেই হবে। সন্তানকে সেই শিক্ষাটি অবশ্যই দিতে হবে, যে শিক্ষায় সে একজন সুনাগরিক হবে। আপনার যন্ত্রণার কারণ হবে না।

সন্তানকে ছোট বয়স থেকেই অর্থাৎ প্রাইমারি স্কুল থেকেই নৈতিকতার শিক্ষা দিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে ডিআইজি বলেন, ছোট থেকেই শেখাতে হবে- সন্তান কার সঙ্গে মিশবে, কার সঙ্গে মিশবে না। কার সঙ্গে কতটুকু ঘনিষ্ঠ হবে, কার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবে না। কোনটি ভালো-কোনটি মন্দ, সেই শিক্ষাটি সন্তানকে সঠিকভাবে দিতে হবে। যদি সেই শিক্ষা আমরা দিতে পারি, তাহলে অপরাধ পরিসংখ্যানের ভেতরে আমাদের সন্তানদের স্থান হবে না। আপনি আমি আমরা ভালো থাকব।

তিনি আরও বলেন, ১ হাজার ৩৮৪টি ধর্ষণ ও অপহরণের যে পরিসংখ্যান, এটি এক বছরের হিসাব। প্রতি বছরই এমন ঘটনা ঘটছে। এই পরিসংখ্যানের বাইরেও অনেক ঘটনা আছে। অনেক সময় মামলা না নিয়ে অভিভাবকের অনুরোধের ভিত্তিতে অপহৃতাকে আইনগতভাবে উদ্ধার করে দিচ্ছি, সেটি তো পরিসংখ্যানের বাইরে থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও অপহরণের একটি বিশাল সংখ্যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেখতে হচ্ছে। এটি অনেকটাই কমে যাবে যদি অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়তে থাকে।

পুলিশের রংপুর রেঞ্জের পক্ষ থেকে সকল অভিভাবকের প্রতি অনুরোধ করে দেবদাস ভট্টাচার্য্য বলেন, ‌আপনার সন্তান যেন আপনার জীবনে দুর্দশার কারণ না হয়, সে জন্য আপনি আরও সচেতন হোন। আপনার সন্তান একজন ভালো মানুষ হয়ে উঠুক, সেটার জন্য সন্তানকে প্রকৃত শিক্ষা দিন। সন্তান যেন কোনোভাবেই আপনার সম্মতি ছাড়া কোনো ধরনের কাজ না করে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর