অর্থনৈতিকভাবে উপকারী হলেও উত্তরে হারিয়ে যাচ্ছে মহিষ
কয়েক বছর আগেও গ্রামাঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষ গরুর পাশাপাশি মহিষ পালনেও বেশ তৎপর ছিলেন। সময়ের বিবর্তনে আর আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গৃহস্থের গোয়ালে এখন আর মহিষ দেখা যায় না। যেখানে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে লালন-পালন করা হতো মহিষ, সেখানে কয়েক গ্রাম ঘুরেও এখন মহিষের দেখা মেলা ভার। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে মহিষ এখন এক বিরল প্রজাতির প্রাণী।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কৃষি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে সার্বিক অবদানের গুরুত্ব বিবেচনায় প্রায় ৫০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে গরুর পরেই মহিষের স্থান। সাধারণভাবে বর্তমানে মহিষকে এশিয়ার প্রাণী বলা হয়।
বিজ্ঞাপন
মহিষ দেখতে কালো, ধূসর অথবা বাদামি রঙের হয়। কৃষিকাজে কর্ষণের শক্তি হিসেবে, কাছাকাছি দূরত্বে পণ্য পরিবহনের কাজে এবং মানুষের নিকটবর্তী পথ চলাচলে গাড়ি টানার জন্য, অর্থসাশ্রয়ী ও পরিবেশদূষণমুক্ত শক্তির প্রয়োজনে, খাদ্যবস্তু হিসেবে তুলনামূলকভাবে অধিক ননী-সমৃদ্ধ দুধ আর মোটা আঁশযুক্ত মাংসের উৎস হিসেবে, জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির জন্য জৈব সার হিসেবে হাড় ও গোবরের ব্যবহার, মানুষের ব্যবহার্য শৌখিন সামগ্রী তৈরির জন্য শিং, হাড় ও চামড়ার ব্যবহারের জন্য মহিষের গুরুত্ব আছে।
জানা যায়, এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব বহু দেশে এটি বহুকাল আগে থেকেই গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। কোনো কোনো দেশে মহিষকে বন্য প্রাণী হিসেবে দেখা হয়, যেমন নেপাল, ভারতের আসাম, মধ্যপ্রদেশসহ মিয়ানমারে। গৃহে লালিত-পালিত হওয়া মহিষ আবার বন্য পবিবেশেও ফিরে গেছে। যেমন শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়সহ আরও কয়েকটি দেশে এমনটা ঘটেছে।
বিজ্ঞাপন
ভারত উপমহাদেশের মহিষ দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে পরিচিত। এ জন্য দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতের মহিষকে দুধ উৎপাদনের মেশিন বলা হয়। গরু পালনের তুলনায় মহিষ পালন তুলনামূলকভাবে সহজ আর কম ব্যয়বহুল। গরু পালনের খরচের তুলনায় মহিষ পালনের ক্ষেত্রে বাসস্থান ও খাদ্য খরচ অনেকটা কম কারণ মহিষ বালুচর আর নদী বিধৌত বাথান এলাকায় সবুজ ঘাস খেয়ে থাকে।
আরও জানা যায়, গরুর তুলনায় মহিষের রোগবালাইও অপেক্ষাকৃত কম। মহিষ গরম সহ্য করতে পারে না, এ কারণে কাদামাটি ও পানিতে গড়াগড়ি করতে পছন্দ করে। আরামের জন্য পানি আর ছায়াযুক্ত জায়গায় থাকতে আরাম বোধ করে। দিনের মধ্যভাগে এবং সূর্যাস্তের কিছুটা আগে মহিষকে বেশ কয়েক ঘণ্টা কাদাপানিতে গড়াগড়ি করে অবস্থান করতে দিতে হয়। মহিষ গড়ে ১৫ বছর বাঁচে এবং সমগ্র জীবন চক্রে প্রায় ১৬ থেকে ১৭টি বাচ্চা প্রদান করে থাকে।
ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার কৃষক এম এ গফুর বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে আসতাম বাপ-দাদাদের সঙ্গী ছিল মহিষ। মহিষ দিয়ে আমরা অনেক মালবাহী গাড়ি টানতাম, জমিতে হালচাষ করাতাম। মহিষ আমাদের কৃষি পরিবারের জন্য উপকারী একটি প্রাণী। মহিষের মাংস বেশ পুষ্টিকর ও অনেক সুস্বাদু। তবে নানা কারণে এখন আর মহিষ পালন করে না মানুষ।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের নাজমুল হাসান বলেন, কত বছর ধরে মহিষ চোখে দেখতে পাই না, তা মনে আসছে না। ছোটবেলায় আমাদের বাসায় মহিষ পালন করতাম। বিক্রি হওয়ার পর আর কখনো মহিষ চোখে পড়েনি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় মহিষ এখন বিলুপ্তির পথে।
অনেক কিশোর-কিশোরীর কাছে মহিষ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা কেউ কখনো মহিষকে স্বচক্ষে দেখেনি বলে জানায়।
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলে, আমি বইয়ে নাম শুনেছি ও ছবি দেখেছি মহিষের। কোনো দিম স্বচক্ষে দেখা হয়ে ওঠেনি। আমি মনে করতাম এটা মনে হয় জঙ্গলে (বুনো) বসবাস করেন, এমন প্রাণী।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, আগের মতো আর মহিষ পালন করা হয় না গ্রামেগঞ্জে। আর মহিষের খামারও সেভাবে পরিলক্ষিত হয় না। তবে জেলার কয়েকটি জায়গায় দু-একটি করে মহিষ পালন করা হয়। সময়ের বিবর্তনে এ গবাদি প্রাণীটি হারিয়ে যাচ্ছে। তবে মহিষ পালনে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ আছে।
এনএ