ভাষা আন্দোলনই বাংলাদেশের মূল শেকড়
ভাষাসৈনিক আশরাফ হোসেন। রংপুরের মানুষের কাছে যিনি ‘বড়দা’ নামে বেশি পরিচিত। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তার জড়িয়ে পড়ার গল্পটা একটু ভিন্ন। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি প্রবন্ধ পড়ে ভাষা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। সঙ্গে প্রগতিশীল শিক্ষক সন্তোষ গুহ ও কবি শাহ আমানত আলীর কাছে পেয়েছিলেন প্রাণের ভাষা বাংলার জন্য অনুপ্রেরণা।
ভাষার জন্য সত্তর বছর আগের সেই আন্দোলন-সংগ্রাম ভাষাসৈনিক আশরাফ হোসেনকে এখনো কাঁদায়। ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতির স্বপ্ন না দেখা এই ভাষাসৈনিকের চাওয়া ‘ভাষা আগ্রাসন’ বন্ধ হোক। সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করেছেন ভাষাসৈনিক আশরাফ হোসেন বড়দা।
বিজ্ঞাপন
ভাষা আন্দোলনে জড়ানোর বিষয়ে আশরাফ হোসেন বড়দা জানান, ১৯৫২ সালে তিনি লালমনিরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ছোট থেকেই সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও ক্রীড়াঙ্গনে তার বিচরণ ছিল। স্কুলের বাইরে লালমনিরহাট শহরেও ছোটবড় সবার কাছেই তিনি খুব পরিচিত মুখ ছিলেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান করতে গিয়ে তিনি শিক্ষক সন্তোষ গুহের সান্নিধ্যে যান। ওই শিক্ষক ছিলেন প্রগতিশীল। এ কারণে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বহুবার তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। মূলত জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি লেখা পড়ে রাষ্ট্রভাষার প্রতি উদ্বুদ্ধ হন। এরপর শিক্ষক সন্তোষ গুহ ও কবি শাহ আমানত আলীর কাছ থেকেই প্রাণের ভাষা বাংলার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
ঢাকার পল্টন ময়দানে খাজা নাজিম উদ্দিন যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন, তখন থেকেই সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। ওই সময় শিক্ষক সন্তোষ গুহের সঙ্গে আলোচনায় বসেন আশরাফ হোসেন বড়দা। প্রিয় শিক্ষকের মুখ থেকে ভাষা আন্দোলন শুরুর প্রেক্ষাপট জেনে নেন।
বিজ্ঞাপন
সেই শিক্ষকের উদ্ধৃতি দিয়ে ভাষাসৈনিক আশরাফ হোসেন বলেন, পাক-ভারত স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে আলীগড় ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর জিয়াউদ্দিন আহমেদ এক বক্তৃতায় বলেন- ভারতের রাষ্ট্রভাষা হবে হিন্দি। অনুরূপ কারণে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এটাকে তিনি যুক্তিসংগত মনে করতেন। তার ওই বক্তব্যের বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন জ্ঞানতাপস ড. মোহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি (শহীদুল্লাহ) একটা নিবন্ধে লিখেছিলেন- যদি রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হয়, তাহলে বাঙালি ভাষাভাষীর জন্য এটা রাজনৈতিক পরাজয়ের নামান্তর। সেই নিবন্ধটি আমার মনে ভীষণ দাগ কেটেছিল। কারণ সেই নিবন্ধের কথাগুলো তখনকার সাড়ে তিন কোটি জনগণের চিন্তা-ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ছিল।
খাজা নাজিম উদ্দিন প্রসঙ্গে এই ভাষাসৈনিক বলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের রক্ত ঝরলেও খাজা নাজিম উদ্দিনের অবস্থান ছিল বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে। তখন তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তিনি ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে চুক্তি করেন। ১৯৪৮-১৯৫১ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এরপর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েও সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করেননি। ঢাকার নবাব পরিবারের জন্মগ্রহণ করা একজন বাঙালি রাজনীতিবিদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন।
আশরাফ হোসেন জানান, নাজিম উদ্দিনের বক্তব্য শুনে নিজেদের ঠিক রাখতে পারেননি তিনি। প্রতিবাদ জানাতে স্কুলে স্ট্রাইক করেন। এর জন্য অনেক কষ্ট পোহাতে হয়। সন্ধ্যায় যখন শুনলেন ভাষার জন্য সালাম, রফিক, বরকতসহ অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। ছাত্রদের এই আন্দোলন এবং শাহাদতবরণ করার খবরটি ভীষণ মর্মাহত করে তাকে। ছাত্র হয়ে আরেক ছাত্র ভাইয়ের মৃত্যুর খবর ছিল হৃদয়স্পর্শী। ওই স্মৃতি মনে পড়লে এখনো নিজেকে ছাত্র মনে হয়।
তিনি বলেন, লালমনিরহাটের আবুল হোসেনসহ আফছার আহমেদ, ছামছুল হক, আনিছুল হক, ষষ্টী সরকার, নাসির ইদ্দিন, নাসিম আহমেদ, টুকু চৌধুরী, দুলি আপাসহ অসংখ্য ছাত্র মিলে টানা কয়েক দিন আমরা মিছিল করি। বিভিন্ন স্কুলে স্ট্রাইক করা হয়। সব কিছুতে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়।
১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির শোক মিছিলের স্মৃতিচারণ করে ভাষাসৈনিক আশরাফ হোসেন বলেন, এ রকম আন্দোলন আগে করা হয়নি। হাতে কালো পতাকা, বুকে কালো ব্যাজ পরে মৌন মিছিল শুরু হয়। ছাত্রদের সঙ্গে বিভিন্ন বয়সী সাধারণ মানুষও অংশ নেয়। রাস্তার দুই পাশে ৫০ গজ দূরে রাইফেল হাতে ইপিআর সদস্যরা দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের দেখে আমাদের রক্ত গরম হয়ে যায়, সবার মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে। তখন মিছিল আর মৌন থাকেনি। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত মিছিলটি জঙ্গি মিছিলে পরিণত হয়। তখনকার মিছিলে স্লোগান ছিল নাজিম-নুরুল দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।
আশরাফ হোসেন বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকেই স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। সেই আন্দোলনের উৎস পুরুষ ছিলেন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তার ব্যক্তিত্ব, প্রতিবাদী নিবন্ধ ও সাহসী উচ্চারণের জন্য তখন শিক্ষিত সমাজের সবাই আন্দোলিত হয়েছিল। অনেক গুরুত্ব ছিল তার লেখা ও কথার। সেই গুরুত্বটা উপলব্ধি করতে পারার কারণেই দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়।
ভাষা আন্দোলন করার কারণে আশরাফ হোসেন ১৯৫৪ সালে আত্মগোপনে চলে যান। এরপর ১৯৫৫ সাল থেকে রংপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। নগরীর গুপ্তপাড়ার নিউক্রস রোডের ডুয়ার্স ভবনই এখন ভাষাসৈনিক আশরাফ হোসেনের ঠিকানা।
বায়ান্নর আন্দোলনমুখর সময়ে আশরাফ হোসেন ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। এরপর ন্যাপ-ভাসানী করলেও পরে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি হয়ে নাম লেখান সাত দলে। সর্বশেষ তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। কিন্তু তা টেকসই হয়নি, সেখানও থেকে পদত্যাগ করেন। বর্তমানে তিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। কখনো লাঠিতে, নয়তো অন্যের হাত ধরে চলাফেরা করেন। কমেছে স্মৃতিশক্তিও। তবে ৭০ বছর আগের ভাষা সংগ্রামের দিনগুলোর স্মৃতি স্মরণ করতে ভুল হয় না তার।
আশরাফ হোসেন বড়দা বলেন, যে আকাঙ্ক্ষায় ভাষা আন্দোলন করেছিলাম, তা আজও পাইনি। সুন্দর একটি সমাজ গড়তে পারলাম না। সত্যিকারের স্বাধীনতা আনতে হলে ভাষা আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। ভাষা-সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরে এখনো অবক্ষয়। এই অবক্ষয়ের হাত থেকে মুক্তি পেতে হবে। তা না হলে ভাষা শহীদদের প্রতি অবজ্ঞা করা হবে। আকাশসহ বিভিন্ন অপসংস্কৃতির কারণে এ দেশের তরুণদের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে। সব ধরনের অপসংস্কৃতির লাগাতার উৎকট আগ্রাসনের প্রতিরোধে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে।
এই ভাষাসৈনিক বলেন, ভাষা আন্দোলন না হলে হয়তো আজকের বাংলাদেশ হতো না। ভাষা আন্দোলনই ছিল বাঙালির সাহসিকতার প্রমাণ। ২১ ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ পরবর্তীতে ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচনে জয়; এগুলো মুক্তিযুদ্ধে পূর্ববাংলার মানুষের সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ভাষা আন্দোলনই বাংলাদেশের মূল শেকড়।
শুদ্ধ বাংলা চর্চা, সর্বত্র বাংলার ব্যবহার এবং আঞ্চলিক ভাষা টিকে রাখার নিজস্ব সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরার পরামর্শ দিয়ে আশরাফ হোসেন বড়দা বলেন, আঞ্চলিক ভাষা তো মায়ের ভাষা, নিজের গ্রামের ভাষা। এটা নিজের প্রথম বুলি। আঞ্চলিকতা মানে সংকীর্ণতা নয়। এই ভাষার মাঝেই আত্মপরিচয় আছে। মায়ের ভাষায় কথা বলতে লজ্জা করা যাবে না। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
আরএআর