একসঙ্গে পাঁচ ছেলেকে হারিয়ে মানু রানী সুশীলের কান্না যেন থামছেই না। পাঁচ ছেলের চাকরির কাগজপত্র, সেজো ছেলের পাসপোর্ট ও ছবি বুকে জড়িয়ে থেমে থেমে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠছেন তিনি। কোনো সান্ত্বনাই স্বপ্নভাঙা মায়ের আহাজারি থামাতে পারছে না। তার চিৎকার আর বুক ফাটা আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। তাকে সান্ত্বনা দিতে আসা মানুষগুলোও নীরবে অশ্রু ফেলছেন। 

শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সকালে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট এলাকায় নিহতদের বাড়িতে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। 

সদ্যপ্রয়াত বাবা সুরেশ চন্দ্র সুশীলের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এসে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মালুমঘাট এলাকায় পিকআপ ভ্যানচাপায় পাঁচ ছেলে অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫), চম্পক সুশীল (৩০) ও স্মরণ সুশীল (২৯) নিহত হন। ছেলেদের  এভাবে চলে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না মা মানু রানী সুশীল। 

কদিন আগেই ছেলে স্মরণের কন্যাশিশুর জন্ম হয়। সবাই খুশিতে উৎফুল্ল ছিল। নাতনির ষষ্ঠী অনুষ্ঠানের জন্য নানা আয়োজন করার চিন্তা করেছিলেন দাদি মানু রানী সুশীল। ষষ্ঠী অনুষ্ঠানের পাঁচ দিন আগে স্বামী অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী সুরেশ চন্দ্র সুশীল পরলোক গমন। এতে পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে। ষষ্ঠী অনুষ্ঠান পিছিয়ে দেওয়া হয়। তবে সেই অনুষ্ঠান আর করা হয়নি, করতে হয়েছে পাঁচ ছেলের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। 

মানু রানী সুশীল বলেন, ‘যাদের মানুষ করেছি, তাদের নিয়ে গেছে। কাদের জন্য বাঁচব? মা হয়বো হনে ডাকিবো (মা বলে কে ডাকবে)।’

একটু পর পরই আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিলেন মানু রানী। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না প্রতিবেশীরা।

প্রসঙ্গত, সদ্যপ্রয়াত বাবা সুরেশ চন্দ্রের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এসে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মালুমঘাট এলাকায় পিকআপ ভ্যানচাপায় পাঁচ ছেলে অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫), চম্পক সুশীল (৩০) ও স্মরণ সুশীল (২৯) নিহত হন। 

ঘটনার ১০ দিন আগে তাদের বাবা সুরেশের মৃত্যু হয়। বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগ দিতে তারা ৯ ভাইবোন বাড়িতে সমবেত হয়েছিলেন। সেখানকার একটি মন্দিরে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শেষে একসঙ্গে ৯ ভাইবোন (৭ ভাই ও ২ বোন) হেঁটে বাড়িতে আসার জন্য সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় পিকআপের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই একসঙ্গে চারজনের মৃত্যু হয়, বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরেক ভাই। 

ঘটনায় অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান সুরেশ চন্দ্র সুশীলের মেয়ে মুন্নী সুশীল। আহত হন সুরেশ চন্দ্রের আরও দুই ছেলে ও এক মেয়ে। আহতদের মধ্যে রক্তিম শীল চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে আছেন। নিহতদের বোন হীরা শীল মালুমঘাট খ্রিষ্টান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে তার একটি পা কেটে ফেলা হয়েছে।

নিহতদের বোন মুন্নী সুশীল বলেন, ঘটনার সময় অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। আমরা মৃত বাবার জন্য পূজা শেষে বাড়ি ফিরতে রাস্তা পার হচ্ছিলাম। তখনই পিকআপটি ধাক্কা দিলে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। পিকআপ প্রথমে ধাক্কা দিয়ে কিছুদূর সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। পরে চালক গাড়িটি পিছনের দিকে চালিয়ে এনে চাপা দিয়ে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে।  এটা নিছক দুঘর্টনা নয়, হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেন তিনি। 

এদিকে পাঁচ ভাইকে চাপা দেওয়া পিকআপ ভ্যানের চালক সাহিদুল ইসলামকে শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে আটক করেছে র‌্যাব। তাকে আটকের পর র‌্যাব জানায়, ঘটনার দিন রাস্তায় অধিক কুয়াশা থাকা সত্ত্বেও চালক দ্রুত কক্সবাজার পৌঁছে সবজি ডেলিভারি দেওয়ার জন্য বেপরোয়াভাবে পিকআপটি চালাচ্ছিলেন। অধিক কুয়াশা ও অতিরিক্ত গতির কারণে মালুমঘাট বাজারের নার্সারি গেটের সামনে রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষারতদের দূর থেকে লক্ষ্য করেননি তিনি। গাড়ির অধিক গতি থাকার কারণে কাছাকাছি এসে লক্ষ্য করলেও গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারায় দুর্ঘটনাটি ঘটে। 

সাইদুল ফরহাদ/আরএআর