স্বাধীনতার ৫১ বছর পর নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দক্ষিণ-পূর্বের শেষ সীমান্তের দোছড়ি ইউনিয়নে জ্বলল বিদ্যুতের আলো। সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। গত শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পর হাজার হাজার মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো।

এর ফলে সীমান্তে কৃষি, শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটবে বলে প্রত্যাশা স্থানীয়দের। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিদ্যুৎ পেয়ে প্রত্যেক মানুষ উচ্ছ্বসিত।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে মধ্য-পূর্বাংশজুড়ে দোছড়ি ইউনিয়ন। এর তিন পাশজুড়ে রয়েছে আলীকদম, বাইশারী, গর্জনিয়া-কচ্ছপিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়ন এবং মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো। সেই লক্ষ্যে দুর্গমতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সীমান্তবর্তী এলাকা বিবেচনায় দোছড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছানো হয়েছে।

এ বিষয়ে দোছড়ি ইউনিয়ন যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, একদিকে সীমান্ত, অন্যদিকে দুর্গম অঞ্চল। এ কারণে দোছড়ির মানুষ কখনো বিদ্যুতের স্বপ্ন দেখিনি। সৌরসোলার ছিল সর্বোচ্চ পাওনা। তবে পার্বত্য বিষয়কমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে স্বাধীনতার পর এই প্রথম আমরা বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হলাম।

এদিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় রুমা বাজার থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ৬৫টি বম পরিবারের প্রশান্তময় পাহাড়ি গ্রাম মুনলাই পাড়া। বান্দরবান শহর থেকে মাত্র দুই-আড়াই ঘণ্টার যাত্রায় মুনলাই পাড়ার গ্রাম এত দিন ছিল অন্ধকারে। এখানে তিন শতাধিক মানুষের বসবাস। এবার বিদ্যুৎসংযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত সব পরিবার।

চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত এবং সাঙ্গু নদী বিধৌত এ পাড়াটিতে বম সম্প্রদায়ের জীবনধারা। কৃষি, শিক্ষা, যোগাযোগ, ব্যবস্থায় উন্নত হলেও বিদ্যুৎ-সংযোগ না থাকায় নাগরিক জীবনের অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল এ পাড়ার মানুষ। অবশেষে এই নাগরিক সুবিধা পেতে যাচ্ছে রুমার আদর্শ গ্রামের ৬৫টি পরিবারের লোকজন। মুনলাই পাড়ার প্রতিটি ঘর আলোকিত হলো বিদ্যুতের আলোতে।

গত শুক্রবার (১১‌ ফেব্রুয়ারি) সকালে বান্দরবানের রুমা উপজেলার মুনলাই পাড়া এলাকায় ৯৯ লাখ টাকা ব‍্যয়ে বিদ্যুতের লাইনের উদ্বোধন করেন পার্বত্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং।

মন্ত্রী বলেন, আমরা দেশের সুষম উন্নয়নে বিশ্বাসী। কাজেই আমাদের লক্ষ্য শুধু শহরেই নয়, তৃণমূলের গ্রামগঞ্জের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের সেবা পৌঁছে দেওয়া।

স্বাধীনতার ৫১ বছর পর হলেও এ জনপদে বিদ্যুৎ-সংযোগ পেয়ে মুনলাই পাড়া গ্রামের মানুষ জেগে উঠেছে।

বান্দরবানের পাহাড়ে পাহাড়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যে বসতি বা পাড়া চোখে পড়ে, মুনলাই পাড়া সেগুলো থেকে ব্যতিক্রম। পাহাড়ি রাস্তার দুই ধারে নানা রকম রঙিন ফুলের গাছ, ঝকঝকে ছোট ছোট বাড়ি, যেগুলো স্বাভাবিকভাবেই মাচার ওপর। কয়েকটি ঘর রঙিন টিনে ছাওয়া। মেঝেগুলো কাঠের। বাংলাদেশের অন্যতম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে স্বীকৃত এ পাড়াটি।

জানা যায়, ১৯৮৩ সালে স্থানীয় ৩০টি বম পরিবার সুনসংপাড়া থেকে এসে জনপ্রতি পাঁচ একর করে জায়গা নিয়ে মুনলাইপাড়ায় বসবাস শুরু করে। এখন ৬৫ পরিবার এই পাড়ায় বসবাস করছে। তারা সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করেন। ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় দেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামের তকমা পেয়েছে তাদের ছোট্ট মুনলাই পাড়া।

পুরো পাড়ার কোথাও ময়লা-আবর্জনা পাবেন নেই। সেখানকার ডাস্টবিনগুলোও দেখার মতো। নিজেদের গ্রামকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে অনন্য সব উদ্যোগ নিয়েছে মুনলাই পাড়া কমিউনিটি ট্যুরিজম কো-ম্যানেজম্যান্ট কমিটি।

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, এ গ্রামের বাসিন্দারা কেউই ঘরে কখনো তালা লাগান না। কারণ, সেখানে চুরি হওয়ার কোনো ভয়ই নেই। বাসিন্দারা একই পরিবারের সদস্য হিসেবে নিজেদের ভাবেন। এ কারণে ঘর খোলা রেখেই কেউ বাইরে গেলে তার প্রতিবেশী নিজের মনে করেই বাড়িটি পাহারা দেন, যা বর্তমান সময়ে দৃষ্টান্তমূলক।

বমপাড়ার তরুণ অনুপম। তিনি পড়াশোনা করছেন চট্টগ্রাম ডিগ্রি কলেজে। অনুপম জানালেন, মুনলাইপাড়ায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাতজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষার হারও অনেক বেশি। গ্রাম পরিচ্ছন্ন রাখাসহ সার্বিক বিষয় দেখভালের জন্য একটি পাড়া কমিটি রয়েছে। 

পাড়ার প্রধানকে বলা হয় 'কারবারি'। এই গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে সুন্দর গোছানো 'মুনলাই সেন্টার ও পাঠাগার'। মুনলাই সেন্টারে মাঝেমধ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বমরা। তাদের নাচ-গান বিমোহিত করে পর্যটকদের। তাদের জনপ্রিয় নৃত্য 'বাঁশনৃত্য'।

মুনলাই পাড়ার বাসিন্দা জেনি বম বলেন, আমাদের এলাকায় আজ বিদ্যুৎ-সংযোগ পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই।

বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) উজ্জল বড়ুয়া বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মুজিব বর্ষে প্রতিটি ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছানো। সেই লক্ষ্যে মুনলাই পাড়া এবং দোছড়িতে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ৫৬৫ কোটি টাকায় বিদ্যুৎ উন্নয়নে কাজ চলছে। এর আওতায় ১৫২৫ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন, ১৬টি সাব-স্টেশন নির্মাণ হয়েছে। বাকি এলাকাগুলোকেও বিদ্যুতের আওতায় আনা হবে।

রিজভী রাহাত/এনএ