কুয়াকাটায় বন উজাড় করে বেড়িবাঁধ সংস্কার
পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় বেড়িবাঁধ সংস্কারে মাটির পরিবর্তে বালু ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে। ফলে বেড়িবাঁধের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এলাকাবাসী। এমনকি বালুর ওপর মাটির প্রলেপ দিতে কাটা হচ্ছে সংরক্ষিত বনের মাটি। এতে বনের ৫০-৬০ বছরের পুরোনো শত শত গাছ উজাড় হচ্ছে। এক বছর ধরে বন ধ্বংস করা হলেও নির্বাক বনবিভাগের কর্তাব্যক্তিরা।
এদিকে ২০২১ সালের ১০ মার্চ গঙ্গামতি বিট কর্মকর্তা মহিপুর রেঞ্জ অফিস বরাবর একটি অভিযোগপত্র দায়ের করার মধ্যদিয়ে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করেছেন। কিন্তু নেওয়া হয়নি কোনো আইনগত ব্যবস্থা।
বিজ্ঞাপন
বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজে নিয়োজিত সাব ঠিকাদার থেকে শুরু করে প্রকল্প প্রকৌশলীরা বলছেন, বনবিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করেই তারা বনের ভেতর থেকে মাটি কাটছেন। প্রতিদিনই বনবিভাগের কর্মকর্তারা উপড়ে ফেলা গাছ কেটে সরিয়ে নিচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন ঠিকাদাররা। বন উজাড় করে মাটি কেটে নেওয়ার ফলে পরিবেশের ওপর মারাক্তক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন পরিবেশ আইনবিদরা।
বিজ্ঞাপন
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না সিকো কোম্পানি ও বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে ৬ বছর ধরে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ চলছে। বেড়িবাঁধ সংস্কারের মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা প্রকল্পের উদ্দেশ্য। উপকূলীয় এলাকার মানুষকে জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য।
জানা গেছে, চায়না সিকো কোম্পানির বেড়িবাঁধ সংস্কার প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এরপর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। ওই কোম্পানি কাজের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য দুই দফা সময় নিয়েছে। বর্ধিত মেয়াদের মধ্যে ৮০ ভাগ কাজ শেষ করতে না পারলে প্রকল্প বাতিল হয়ে যাবে। কাজ শেষ না করতে পারার শঙ্কায় কোম্পানি স্থানীয় সাব ঠিকাদারদের কাজ ভাগ করে দিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কুয়াকাটার ৪৮ নং পোল্ডারের খাজুরা ও গঙ্গামতি সংরক্ষিত বনের মাঝখানে বড় বড় দিঘি কাটা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও খাল কেটে মাটি নেওয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের স্লোভ থেকে প্রায় ৪০০-৫০০ মিটার বনের ভেতর থেকে গাছ উপড়ে মাটি নেওয়া হয়েছে। এখনও চলমান রয়েছে এসব ধ্বংসযজ্ঞ।
বেড়িবাঁধ সংস্কার করতে মাটি বাইরে থেকে না কিনে সাব ঠিকাদাররা বনবিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বনের ভেতর থেকে মাটি নিয়ে ব্যবহার করছে। বনের লবণনযুক্ত পলিমাটির সঙ্গে বালুযুক্ত এসব মাটি ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে নাজুক বাঁধ। স্থানীয়দের মতে, এ বেড়িবাঁধ টেকসই হবে না। বেড়িবাঁধে বালু দিয়ে তার ওপরে মাটির প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে।
কথা হয় সাব ঠিকাদার মহসিন ও জামালের সঙ্গে। তারা জানান, মাটির দাম ধরা হয়েছে খুবই কম। এ টাকা দিয়ে মাটি কেনা সম্ভব নয়। এই টাকা শুধু মাটি আনা-নেওয়ার কাজেই ব্যয় হয়।
তারা আরও জানায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বনের ভেতর থেকে মাটি কেটে নিচ্ছেন তারা। প্রতিনিয়ত বনবিভাগের কর্মকর্তারা দেখাশুনা করছেন। মাটির মান নিয়ে তিনি বলেন, মাটি পাওয়া যাচ্ছে না, তাই বনের পলিমাটি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এ মাটি ব্যবহারে প্রকল্প প্রকৌশলীদের সম্মতি আছে।
পটুয়াখালী বনবিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম বলেন, বন উজাড় করে মাটি কেটে বেড়িবাঁধে ব্যবহারের বিষয়ে স্থানীয় বিট কর্মকর্তা ২০২১ সালের ১০ মার্চ একটি লিখিত অভিযোগ তার কাছে দিয়েছেন। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে। কোনো মামলা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা পেলে মামলা করা হবে।
সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের প্রকৌশলী মো. মজিবুর রহমান বলেন, গাছ উপড়ে ফেলে বনের ভেতর থেকে মাটি কাটার বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। কাজের অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে এসে প্রকল্পের সচিব, পরিচালকসহ একটি প্রতিনিধি দল পরিদর্শন করে গেছেন। পরিদর্শন রিপোর্ট দিলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন তারা।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন, বন উজাড় করে মাটি নিয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার করা বন ও পরিবেশ আইনে কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস করে বনের ভেতরে পুকুর বা দিঘি কাটা আইনবিরোধী কাজ। বনবিভাগ তাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন না করে এতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সমর্থন করে নৈতিকতাবিরোধী কাজ করছেন। সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের নামে এমন ধ্বংসযজ্ঞ পরিবেশের ওপর মারাত্মক হুমকি বয়ে আনবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন বলেন, বালু দিয়ে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। বেড়িবাঁধ মাটি দিয়ে হয়, মাটি দিয়েই হবে। কার্যাদেশ মানা না হলে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসপি