ভোজ্য তেলের অনিয়ন্ত্রিত বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন পথে হাঁটছে সরকার। রমজানের আগেই দেশের বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে ভোজ্য তেল সরবরাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জরুরি পদক্ষেপ চেয়েছে।

যার অংশ হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ভ্যাট প্রত্যাহারের অনুরোধ করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে এনবিআর। মন্ত্রণালয়ের চিঠি নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ। ভ্যাট প্রত্যাহার কিংবা কমিয়ে যেকোনো সময় নতুন এসআরও জারি করতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। এনবিআরের ঊর্ধ্বতন (ভ্যাটনীতি) এক কর্মকর্তা মঙ্গলবার (৮ মার্চ) ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে গত ১ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এনবিআরে এ বিষয়ে একটি চিঠি আসে। এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম বরাবর চিঠিতে বলা হয়, ২০২০ সালের আগস্ট থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের দামের ঊর্ধমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। ঊর্ধ্বমুখী আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের প্রভাবে স্থানীয় বাজারে ভোজ্য তেলের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মেট্রিক টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল প্রায় ১৫৩০ মার্কিন ডলার এবং প্রতি টন অপরিশোধিত পাম তেল আন্তর্জাতিক বাজারে ১৫০৮ থেকে ১৫২০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। যা স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।

স্থানীয় বাজারে বর্তমানে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৮ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৪০ টাকা থেকে ১৪৫ টাকা এবং প্রতি লিটার খোলা পাম তেল ১০০ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যে আমদানিকৃত অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল স্থানীয় মিলে পরিশোধিত হয়ে বাজারে প্রবেশ করলে প্রতি লিটার সয়াবিন ও পাম তেলের দাম আরও বাড়বে। ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা বিবেচনায় ভোজ্য তেলের বর্তমান দাম অস্বাভাবিক বলে প্রতীয়মান।

অপরিশোধিত তেলের বর্তমান মূল্য বিবেচনায় গত ৬ মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। সে হিসেবে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, অপরিশোধিত পাম তেল ও পামওলিন আমদানিতে এর শুল্কায়নযোগ্য দামের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলেও এ খাতে সরকারের কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আহরণের পরিমাণ কমার সম্ভাবনা নেই। সেই সাথে অত্যাবশ্যকীয় এ পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় গতি সৃষ্টির লক্ষ্যে বর্তমানে আরোপিত উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য সংযোজনের ওপর ১৫ শতাংশ ও ব্যবসায়িক পর্যায়ে মূল্য সংযোজনের ওপর ১৫ শতাংশ বা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট হতে শর্তসাপেক্ষে অব্যাহতি প্রদান করা প্রয়োজন। তাই অত্যাবশ্যকীয় ভোজ্য তেলের বাজার মূল্য এবং সরবরাহ লাইনে স্থিতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে অব্যাহতি প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব খন্দকার নুরুল হকের স্বাক্ষরে দেওয়া চিঠিতে ২০১১ সালের উদাহরণ টেনে বলা হয়, এর আগেও ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছিল। তখন স্থানীয় বাজারে পরিশোধিত ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধি পায়। সে সময় সরকার জন সাধারণের ক্রয়-ক্ষমতা বিবেচনায় এনে আমদানি পর্যায়ে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, অপরিশোধিত পাম তেল ও পামওলিন আমদানিতে শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের ৬৭.৬৭ শতাংশের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট রেখে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য এক তৃতীয়াংশ কমায়। ফলে ভ্যাটের হারও এক তৃতীয়াংশ কমে। পরবর্তীতে সময়ে সময়ে এসআরও জারির মাধ্যমে ওই আদেশের মেয়াদ ২০১৭ সালের ৩০ জুন ২০১৭ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। ফলে সাধারণ ভোক্তারা এর সুফল পায়। তাছাড়া সম্প্রতি স্থানীয় বাজারে চালের মূল্যে স্থিতিশীলতা আনয়নে চাল আমদানিতে শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে।

এনবিআর পরিচালক (জনসংযোগ) সৈয়দ এ মু’মেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব নিয়ে এনবিআর কাজ করছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে আমরা গণমাধ্যমকে জানিয়ে দেবো। তাছাড়া এনবিআরের ওয়েবসাইটেও প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে।

এদিকে অধিকাংশ দোকানেই মিলছে না ভোজ্য তেল। তেলের জন্য হাহাকার উঠেছে সর্বত্র। দোকানিরা অর্ডার দিয়েও সয়াবিন থেকে শুরু করে সকল ধরনের ভোজ্য তেল কিনতে পারছে না। তাদের অর্ডার ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। অনিয়ম ঠেকাতে তেলের গুদামে অভিযানও চালানো হচ্ছে। কিন্তু তাতেও সুফল মিলছে না।

এর আগে ২০২১ সালে ১৯ এপ্রিল সয়াবিন তেল ও পাম তেল আমদানিতে ৪ শতাংশ অগ্রিম কর প্রত্যাহার করেছিল এনবিআর। ভোজ্য তেলের মধ্যে সয়াবিন, পাম এবং পামওলিন তেলের ওপর আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ আগাম কর (এটি), উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং বিক্রয় ও সরবরাহ পর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট রয়েছে। এর মধ্যে ধাপে ধাপে আমদানি পর্যায়ে আগাম কর প্রত্যাহার করা হয়।

আরএম/এইচকে/