ক্ষুদ্র-মাঝারি ও নতুন শিল্প উদ্যোক্তাসহ সব শ্রেণির জন্য বিনিয়োগবান্ধব কর কাঠামোর সুপারিশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)।

এফবিসিসিআই মনে করে, সুষম কর ব্যবস্থা, ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ ও উৎপাদনশীলতার ধারাবাহিক বৃদ্ধি সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ করের বিদ্যমান অনুপাত ৩৫:৬৫ থেকে অতিদ্রুত ৬৫:৩৫ হারে নামিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

আসছে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যবসায়ী সংগঠনটি তাদের মৌলিক প্রস্তাবনায় এ বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে যাচ্ছে। সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বিষয়গুলো উপস্থাপন করবেন বলে জানা গেছে।

মঙ্গলবার (২২ মার্চ) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং এফবিসিসিআইয়ের যৌথ উদ্যোগে পরামর্শক কমিটির ৪২তম সভায় এসব প্রস্তাবনা নিয়ে  আলোচনা হবে। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উপস্থিত থাকবেন।

এফবিসিসিআই মনে করে কর হার কমিয়ে করনেট সম্প্রসারণে করযোগ্য বিভিন্ন পেশার ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে আয়কর ও মূসকের আওতায় আনার উদ্যোগ আগে নিতে হবে। যার মধ্যে রয়েছে— সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ধরনের কাজে টিআইএন নম্বর ও কর পরিশোধের প্রমাণ দাখিল বাধ্যতামূলক করা এবং স্থানীয় সরকারের দেওয়া ট্রেড লাইসেন্সের পরিবর্তে সব উদ্যোক্তার কর নিবন্ধনকে বিনিয়োগের প্রামাণিক দলিল হিসেবে গণ্য করা।

সংগঠনটি মনে করে রাজস্ব আহরণ এবং রাজস্ব পলিসি কার্যক্রম পৃথক করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন বিভাগ গঠন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে রাজস্ব আহরণ থেকে রাজস্ব পলিসি কার্যক্রম পৃথক করে ২০০৮ সালে এনবিআরের জারি করা আদেশ অনতিবিলম্বে বাস্তবায়ন করা জরুরি।

এফবিসিসিআই ব্যবসায়িক খরচ, সময় এবং হয়রানি কমাতে শুল্ক মূল্যায়ন, এইচএস কোডের শ্রেণিবিভাগের বিষয়ে স্পষ্টীকরণ, আন্ডার ইনভয়েসিং, মিস-ডিক্লারেশন প্রতিরোধ এবং আমদানি বা রপ্তানি পণ্যে ছাড়করণ প্রক্রিয়া যুক্তিযুক্ত ও সরল করার প্রস্তাব দিয়েছে।

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা কার্যকর করতে শুল্ক, মূসক ও আয়কর বিধিমালার প্রয়োজনীয় সংশোধন করার দাবি জানিয়ে শীর্ষ সংগঠনটি বলছে, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতিতে কোনো মামলা নিষ্পত্তি করার পর সরকারের রাজস্ব কম আদায় হলে এ বিষয়ে দুদকসহ সরকারের কোনো সংস্থা আপত্তি উত্থাপন বা আইন কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারবে না— এমন আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাবনাগুলো কয়েকটি ভাগে ভাগ করে এখানে উপস্থাপন করা হলো—

রপ্তানি সহায়ক শুল্ক ও কর প্রস্তাবনা

রপ্তানি বাণিজ্যের ব্যয় এবং সময় কমানোর জন্য রপ্তানি পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত আমদানি করা এবং দেশীয় উপকরণের ওপর পরিশোধিত সব শুল্ক ও কর মওকুফ গণ্য করে একক বিভাগ মারফত ফেরত প্রদান।

অহেতুক খরচ এবং সময় কমানোর জন্য রপ্তানি খাতসহ শিল্প খাতে উৎস ও আগাম কর ফেরত দেওয়ার পরিবর্তে বিলোপ করা।

জমি ক্রয়, নির্মাণ এবং রপ্তানিমুখী শিল্প ও সেবা খাতের ইউটিলিটি বিলসহ অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কিত সব ভ্যাট এবং কর মওকুফ করা।

শিল্পায়ন সহায়ক কর ও শুল্ক কার্যকর করা

মাইক্রো-কুটির খাতে যাদের বার্ষিক টার্নওভার ১৫ কোটি টাকার নিচে সেই সব শিল্পে ৮ বছর পর্যন্ত আয়কর অবকাশ, টার্নওভার ট্যাক্স ১ শতাংশ ও পণ্যের কাঁচামাল, উপকরণ, মেশিনারিজ ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে ন্যূনতম ১-৩ শতাংশ হারে শুল্ক।

ক্ষুদ্র খাতে যাদের বার্ষিক টার্নওভার ৫০ কোটি টাকার নিচে সেই শিল্পে পণ্য খাতে ৩ শতাংশ ও সেবা খাতে ৫ শতাংশ রেয়াতি হারে ভ্যাট। পণ্যের কাঁচামাল, উপকরণ, মেশিনারিজ ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে ন্যূনতম শুল্ক ১-৩ শতাংশ হারে।

একই ভাবে মাঝারি খাতে যেসক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার তিনশ কোটি টাকার নিচে সেক্ষেত্রে পণ্য খাতে ৪ শতাংশ ও সেবা খাতে ৬ শতাংশ রেয়াতি হারে ভ্যাট এবং একই ধরনের যন্ত্রাংশ আমদানিতে একই ধরনের শুল্ক সুবিধা।

বৃহৎ খাতে বার্ষিক টার্নওভার তিনশ কোটি টাকার ওপর এমন শিল্পের ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে প্রযোজ্য ভ্যাট ও পণ্যের কাঁচামাল, উপকরণ, মেশিনারিজ ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে ন্যূনতম শুল্ক ১-৩ শতাংশ।

শুল্ক ও কর বিষয়ক প্রস্তাবনা

শিল্প খাতে আবশ্যকীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, সব ধরনের কাঁচামাল এবং যে খাতে ব্যবহৃত হয় তাদের প্রত্যেককে প্রজ্ঞাপনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করায় খাতভিত্তিক অসংগতি দেখা দিচ্ছে। মাইক্রো, ক্ষুদ্র এবং অধিকাংশ মাঝারি খাতের উদ্যোক্তাদের কাঁচামাল ও বিভিন্ন উপকরণ সরাসরি আমদানি করার সচ্ছলতা না থাকায় বাণিজ্যিক আমদানির ক্ষেত্রে উচ্চতর শুল্কের কারণে খোলা বাজার থেকে অত্যধিক মূল্যে ক্রয় করতে বাধ্য হন। তাই এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাবনা হচ্ছে আমদানিকারক নির্বিশেষে মাইক্রো, ক্ষুদ্র-মাঝারি ও নতুন শিল্প উদ্যোক্তাসহ সব শ্রেণির জন্য বিনিয়োগবান্ধব আমদানি শুল্ক স্তর নির্ধারণ করা।

বন্ড সংক্রান্ত প্রস্তাব

বন্ড ও শিল্পায়ন সহায়ক যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা কয়েকটি খাতের মধ্যে সীমিত না করে সব উৎপাদনমুখী খাতের জন্য অবারিত করে ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পখাতসহ গ্রামীণ ও নারী উদ্যোগ, ডিজিটাল ট্রেড এবং রপ্তানিমুখী সেবা ইত্যাদি খাতগুলোকে বন্ডের ওয়্যারহাউজ সুবিধা উন্মুক্ত করা।

আয়কর সংক্রান্ত প্রস্তাবনা

আয়কর কেবলমাত্র করযোগ্য সত্ত্বার আয়ের ওপর আরোপযোগ্য একটি কর বিধায় লেনদেন, বিক্রি বা প্রাপ্তির ওপর আরোপিত আয়কর রহিত করা।

বেতন, ফি, সুদ, লভ্যাংশ (ডিভিডেন্ড) ব্যতীত অন্যান্য লেনদেন বা প্রাপ্তির ওপর উৎসে আয়করসহ আমদানিকালে আরোপিত অগ্রিম আয়কর রহিত করা।

একই আয়ের ওপর একাধিকবার কর আদায় পরিহার করে সব করায়িত আয় চূড়ান্ত করযোগ্য আয়ের হিসাব থেকে বাদ দেওয়া এবং কেবলমাত্র চূড়ান্ত করযোগ্য নিট আয়ের ভিত্তিতে ব্যবসা বা পেশার ওপর আয়কর আরোপ করা।

ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, নিরীক্ষা এবং পরিদর্শন সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বিধিগত পদ্ধতি মোতাবেক পরিচালনা করে স্বচ্ছ ও হয়রানিমুক্ত করা।

স্বেচ্ছাধীন পদ্ধতি পরিহার করে কেবল সুনির্দিষ্ট দালিলিক তথ্য বা প্রমাণের ভিত্তিতে এবং সেই সম্পর্কে করদাতার ব্যাখ্যা গ্রহণ করে আয়কর কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা প্রয়োগের বিধান সীমিত করা ইত্যাদি।

মূল্য সংযোজন কর সংক্রান্ত প্রস্তাবনা

এফবিসিসিআই মনে করে সারা দেশের স্থানীয় ভ্যাটের প্রায় ৮৫ শতাংশ সিগারেট, টেলিফোন ও মোবাইল ফোন, গ্যাস, ব্যাংক, ঔষধ, বিদ্যুৎ, পেট্রোলিয়াম, সিমেন্ট, সিরামিক ও টাইলস এবং বেভারেজের ৫০০টি প্রতিষ্ঠান দিয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ ব্যবস্থায় মনিটরিং করে হাজার হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে ভ্যাটের ভার হ্রাস করলে রাজস্বের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না।

বর্তমানে পৃথক পৃথক এসআরও এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট পণ্য এবং সেবা খাতভিত্তিক বিভিন্ন হারে (৫%, ৭.৫% ও ১০% সুনির্দিষ্ট) মূসক আরোপিত হওয়ায় পণ্য এবং সেবা খাতে কর আপাতনে অসংগতি দেখা দিয়েছে। তাই দেশের ৮৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের স্বার্থ ও সামর্থ্য অনুযায়ী সব পণ্য এবং সেবা খাতের জন্য প্রযোজ্য ভোক্তাবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব এবং রাজস্ববান্ধব সুনির্দিষ্ট স্তরভিত্তিক মূসক হারের মৌলিক বিধান মূল মূসক আইনে যুক্ত করার প্রস্তাবনা দিয়েছে এফবিসিসিআই।

এছাড়া সংগঠনটি নিম্ন আয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যবহার্য্য পণ্য, সাধারণ পণ্য পরিবহন, নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, রি-সাইক্লিং, টেন্ডার বহির্ভূত সরাসরি পণ্য মেরামত বা সার্ভিসিং খাত ইত্যাদি ক্ষেত্রে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতির সুপারিশ করেছে বাজেট প্রস্তাবনায়।

আরএম/এসএসএইচ