দেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হলেও বেকারত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা এখনো পুরোপুরি সক্ষম হইনি বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেছেন, বাজেটে যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টি আনা না হয় তবে বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হবে। এক্ষেত্রে নীতি-নির্ধারকদের আরো পরিকল্পিতভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। 

শনিবার (২৮ মে) 'জাতীয় স্বপ্নবাজেট-২০২২-২৩ : কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কি ধরনের বাজেট প্রয়োজন' শীর্ষক প্রাক-বাজেট অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।

মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস ও দৈনিক আনন্দবাজার ওয়েবিনারটির আয়োজন করে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমানের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ারের চেয়ারম্যান এবং উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান।

বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম ও দৈনিক আনন্দবাজারের বার্তা সম্পাদক নিয়ন মতিয়ুল। বাজেট প্রস্তাবনা পেশ করেন মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটসের আহ্বায়ক ফারুক আহমাদ আরিফ। এনায়েতুল্লাহ কৌশিকের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন জীম মণ্ডল।

শতভাগ মানুষের কর্মসংস্থানের দাবিতে ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকার ‘জাতীয় স্বপ্নবাজেট ২০২২-২৩’ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করেন ফারুক আহমাদ আরিফ। তিনি বলেন, বাজেটে ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকার মধ্যে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২৮ হাজার ৮ কোটি টাকা অর্থাৎ ২৬.০৯ শতাংশ ও উন্নয়ন ব্যয় ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা অর্থাৎ ৬৩.৮০ শতাংশ। 

বাজেটে আয়ের খাত সম্পর্কে আরিফ বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত করগুলো থেকে ৮ লাখ ৩৩ হাজার ২২৫ কোটি টাকা অর্থাৎ ৫০.৮০ শতাংশ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত করগুলো থেকে ১ লাখ ৭৩ হাজার ২০১ কোটি টাকা অর্থাৎ ১০.৫৬ শতাংশ ও কর ছাড়া পাওয়া যাবে ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৫২২ কোটি টাকা অর্থাৎ ৩৮.৬৩ শতাংশ। 

তিনি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ ও ব্যক্তিগত করমুক্ত আয়ের সীমা বার্ষিক ৫ লাখ টাকা প্রস্তাব করেন।

ড. আতিউর রহমান ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ উল্লেখ করে বলেন, দেশের কর্মক্ষম নাগরিকের সংখ্যা সোয়া ৬ কোটি। তবে বেকারের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। সার্বিকভাবে এই অংক অনেক বেশি। করোনায় এটি আরো বেড়েছে। নীতি-নির্ধারকরা যে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে যথাযথ অগ্রাধিকার দিচ্ছেন তা করোনাজনিত অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থার সময়ই লক্ষ্য করা গেছে। মানুষ যাতে বেকার হয়ে না যায় সেজন্য এমএসএসইখাত ও এমএফআইগুলোর জন্য প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।

ড. আতিউর রহমান বলেন, করোনা সংকট কাটিয়ে রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে যাচ্ছে। তবে আমদানি ব্যয়ও বাড়ছে। এটি কমিয়ে আনতে হবে। টেক্সটাইল, কৃষি-প্রক্রিয়াজত পণ্য এবং চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি প্রথমবারের মতো এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার দাঁড়িয়েছে।

সাবেক গভর্নর বলেন, দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জাতীয় পরিকল্পনায় মুখ্য ভূমিকা থাকতে হবে। কারণ এর আগে জাতীয় অষ্টমবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে সোয়া এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ কৌশলের বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে।  

তিনি বলেন, এবারের বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ম্যাক্রো অর্থনীতিকে কীভাবে স্থিতিশীল রাখা যায়। কারণ ইনফ্লেশন বাড়ছে। অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা রয়েছে তা স্থিতিশীল রাখাই হবে আগামী বাজেটে বড় কাজ। অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকলে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিকখাত বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। এজন্য বাজেটে কর্মসংস্থানের বিষয়টি একসূত্রে গেঁথে চিন্তা করতে হবে।

সাবেক গভর্নর পদ্মা সেতুর কারণে অর্থনীতির বিকাশ ও বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বলেন, এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে। তাছাড়া কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আশার আলো দেখান তিনি। তিনি বলেন, আমাদের ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে গেম চেঞ্জার। কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির বিপ্লব ঘটবে। তিনি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।  

অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বাংলাদেশের অসাধারণ গুণ নতুনকে গ্রহণ করার। এই মনোবৃত্তিকে সার্বজনীন করতে হবে। নতুন ও আধুনিকতাকে গ্রহণ করার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তা ধরে রাখতে হবে। সেখানে ধর্মান্ধতা থাকবে না। সম্মিলিতভাবে দেশটি এগিয়ে নেওয়ার যে ভাবনা তৈরি হয়েছে তা আরো মজবুত করতে হবে। এখানে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে দুর্নীতি।

অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, চলতি জাতীয় বাজেটে অনুপাত হচ্ছে পরিচালনে ৬১ ও উন্নয়নে ৩৯ শতাংশ বরাদ্দ। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বাজেটে তা উল্টো। সেখানে পরিচালনে ৩৪ ও উন্নয়নে ৬৬ শতাংশ এবং এমডব্লিউইআরের বাজেটে পরিচালনে ২৬.০৯ ও উন্নয়নে ৬৩.৮০ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবশ্যই উন্নয়ন বাজেট বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য বিষয়গুলোও সামনে আনতে হবে।

তিনি বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে ২০২০ সালে ৬ কোটি ৮২ লাখের মধ্যে ৩ কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। এক বছরে তাতে যুক্ত হয়েছে আরো ২৪ লাখ। মানুষ শহর থেকে গ্রামে চলে গেছে। এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৩.২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে কি ধরনের জনশক্তি প্রয়োজন তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

এস এম রাশিদুল ইসলাম বলেন, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ তরুণ শিক্ষিতদের বেকারত্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে বলে আইএলও জানিয়েছে। তাছাড়া বিআইডিএস জানায়, স্নাতক ডিগ্রিধারীরা মাত্র ৩৪ শতাংশ চাকরি পাচ্ছে অর্থাৎ ৬৬ শতাংশ বেকার। দেশে সার্বিক কর্মসংস্থানের অভাব আছে যা স্বাধীনতার ৫০ বছরেও পূর্ণ হয়নি। এক্ষেত্রে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। অন্যান্য অনেক সূচকে এগিয়ে থাকলেও বেকার সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, পোশাক শিল্পে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিশাল একটি অংশ কাজ করে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে সেইমানের লোক দেশে তৈরি হচ্ছে না। এজন্য শিক্ষাখাতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।

নিয়ন মতিয়ুল বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে দেশে এক কোটি দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজনের চাহিদার কথা জানিয়েছে এফবিসিসিআই। দক্ষ জনবল তৈরিতে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন করতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ঘটলে প্রতি ১২ ঘণ্টায় জ্ঞানের পরিবর্তন হবে। এজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মেলবন্ধন তৈরি করতে হবে। 

জেডএস