যারা টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, তা‌দের জন্য দেশে টাকা ফিরিয়ে আনা এখনই মোক্ষম সময়। কারণ, পাচার হওয়া অর্থ দে‌শে আন‌লে কো‌নো প্রশ্ন করা হ‌বে না— জা‌নি‌য়ে‌ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

শুক্রবার (১০ জুন) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী এমন মন্তব্য করেন। বিকেল ৩টা ১০ মিনিটে বাজেটোত্তর এ সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়।

সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থপাচার ক‌রে পি কে হালদার ভা‌লো অবস্থায় নেই। যে টাকা নি‌য়ে গে‌ছেন, ভারত সরকার ব‌লে‌ছে ফেরত দে‌বে। হালদার‌কেও বের ক‌রে দে‌বে। তাকে দে‌শে আনা হ‌বে। কানাডাও ব‌লে‌ছে, যারা টাকা নি‌য়ে গে‌ছে তা‌দের বা‌ড়ি-ঘর কেনা বন্ধ। এখন সেখানে টাকা নি‌য়ে যাওয়াও বন্ধ। তাই আমি ম‌নে ক‌রি, যারা টাকা নি‌য়ে গে‌ছে তা‌দের জন্য এখনই মোক্ষম সময়  টাকা ফিরিয়ে আনার।

অনেকে না জে‌নেও টাকা নি‌য়ে গে‌ছে— জা‌নি‌য়ে অর্থমন্ত্রী ব‌লেন, এখন সেই টাকা সাদা করে মূল ধারায় আন‌তে পার‌ব। আমি বিশ্বাস ক‌রি এ সু‌যোগ সবাই নে‌বে।

টাকার ধর্ম আছে, সুযোগ বেশি পেলেই চলে যায়

টাকার একটা ধর্ম আছে, একটা বৈশিষ্ট্য আছে— উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, টাকা যেখানে বেশি সুখ, বিলাস পায় সেখানে চলে যায়। টাকা কেউ সুটকেসে করে পাচার করে না। বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পাচার হয়। সেই জায়গা থেকে আমরা দায়িত্ব নিয়েই এ কাজটা করতে যাচ্ছি।

মুস্তফা কামাল বলেন, ‘জার্মানি, ফ্রান্সসহ অনেক দেশ তাদের পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার সুযোগ দিয়েছে। বিশ্বে কখনও কখনও টাকা পাচার হয়ে যায়। পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার বিষয়ে আপনারা বাধা দিয়েন না। এ টাকা ফেরত আনতে না পারলে তো কোনো লাভ নেই। টাকা পাচার আসলে বিভিন্ন কারণে হয়ে যায়। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া সেগুলো বলা যায় না। পাচার নিয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ আসে। সেগুলোর সত্যতা পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নেই। এখনও যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এমনকি তাদের অনেকেই জেলে আছেন।’

তিনি আরও বলেন, মিডিয়াতে পাচার নিয়ে একটি রিপোর্ট হলেই তাকে ধরে ফেলা যায় না বা আমরা বিচার কাজ হাতে নিতে পারি না। আমাদের নিজস্ব সিস্টেম আছে। আমরা জানি সুইজারল্যান্ডে টাকা আছে। কিন্তু সেটা বললেই তো আর বিচার কাজ শুরু করে দিতে পারি না। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়েই কাজ করতে হয়। ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মাধ্যমেই আমাদের অ্যাকশনে যেতে হয়।

অর্থপাচার রোধে করণীয় প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের সবসময় ধর্মের কাছেই ফিরে আসতে হবে। ধর্মের কথা শুনে যদি মানুষ একটু নরম হয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) স্পষ্ট করে বলেছেন, যে ঘুষ দেয় আর নেয়, দুজনের জায়গাই জাহান্নামে। আমরা জাহান্নামে যাওয়ার কাজ না করি।

এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, পাচার করা টাকা বলতে আমরা বলি বিদেশে অর্জিত আয়। টাকা পাচার রোধে আমাদের আইন আছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এটি নিয়ে কাজ করে। এটি তাদের প্রতিদিনের কাজ। টাকা কীভাবে পাচার হয়, কারা করে— সেসব তথ্য-উপাত্ত তারা সংগ্রহ করে।

তিনি বলেন, যে টাকাগুলো পাচার হয়েছে, আমরা সেগুলো আনার চেষ্টা করছি। যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৭টি দেশ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে টাকা ফেরত নিয়ে এসেছে। আমরাও সেই কাজটি করতে যাচ্ছি।

এটা নি‌য়ে কো‌নো প্রশ্ন করা হ‌বে না

আমরা বা‌জে‌টে ব‌লে দি‌য়ে‌ছি, এটা নি‌য়ে কো‌নো প্রশ্ন করা হ‌বে না। এর আগে রে‌মিট্যা‌ন্সেও প্র‌ণোদনা দি‌য়ে ব‌লে‌ছিলাম, কো‌নো প্রশ্ন করা হ‌বে না। আমরা প্রশ্ন ক‌রি‌নি। আগামী‌তেও প্রশ্ন করা হ‌বে না— ব‌লেন অর্থমন্ত্রী।

‘এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইন্দো‌নে‌শিয়া, মাল‌য়ে‌শিয়াসহ ১৪‌টি দেশ এ ধর‌নের সু‌যোগ দি‌য়ে‌ছে। ইন্দো‌নে‌শিয়া এ সু‌যোগ কা‌জে লা‌গি‌য়ে ৯ দশ‌মিক ৬ বি‌লিয়ন ডলার পাচার করা অর্থ ফি‌রিয়ে এনেছে।’

‘আজ‌ হু‌ন্ডির মাধ্য‌মে টাকা নি‌য়ে বি‌দে‌শে ব্যবসা-বা‌ণিজ্য কর‌বেন, বা‌ড়ি-ঘর কর‌বেন, আর কেউ প্রশ্ন কর‌বে না– এটা তো হ‌বে না! এটা ঠিক নয়।’ অর্থমন্ত্রী ব‌লেন, ‘এক সময় আপনা‌কে ঠিকই প্রশ্ন করা হ‌বে। তাই একমাত্র পথ সরকা‌রের আইন ও বি‌ধিনিষেধ মে‌নে সরকা‌রের স‌ঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা। আমি ম‌নে ক‌রি, যে উদ্যোগ নেওয়া হ‌য়ে‌ছে কাজ হ‌বে। দে‌শে টাকা ফি‌রে আস‌বে।’

আমরা কখনই গরিব মারার বাজেট দেইনি

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘গত তিন বছরে আপনারা ঠকেননি। আমরা কখনই গরিব মারার বাজেট দেইনি।’

অনেকে এ বাজেটকে গরিব মারার বাজেট বলছেন, আপনি এ বাজেটকে এক কথায় কী বলবেন— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘গরিব হওয়ার যন্ত্রণা আমি বুঝি। এবারের বাজেট ছাড়া আমি গত তিন বছরে তিনটা বাজেট দিয়েছি। এবারের বাজেটসহ গত তিনবারের কোনো বাজেটই গরিব মারার ছিল না। আমরা সবসময় দেশের জনগণের কথা চিন্তা করে বাজেট দেই।’

মন্ত্রী বলেন, এবার আমরা যে বাজেট প্রণয়ন করেছি, সেটি আমার মনে হয় দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাজেট। সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই এবারের বাজেট দেওয়া হয়েছে। গত তিন বছর (২০১৮ থেকে ২০২১ সাল) আপনারা ঠকেননি। যা বলেছি, তা-ই হয়েছে। গরিব হওয়া যে কত কষ্টের সেটা আমি হাড়ে হাড়ে বুঝি। প্রত্যেকটা গরিব মানুষকে সামনে রেখেই বাজেট করি। সুতরাং, এটা নিয়ে আপনাদের দুশ্চিন্তা করার কারণ নেই। 

‘তবে একটা বিষয় মনে রাখবেন, যখনই কোনো চ্যালেঞ্জ আসে, চ্যালেঞ্জ শুধু একা আসে না, সুযোগও নিয়ে আসে। যেমন- আমাদের রপ্তানি আয় বেড়েছে। এ মুহূর্তে বিশ্বের কোনো দেশের ৫০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় নেই। কিন্তু আমরা করছি। সেজন্যই বলি, চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সুযোগ তৈরি হয়।’

পণ্যের দাম একটু বেশি, স্বীকার করলেন অর্থমন্ত্রী

অর্থমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে আমাদের অনেক পণ্যের দাম একটু বেশি, এটা সত্য। তবে এটা হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। যুদ্ধের ফলে সারাবিশ্বেই নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এখানে কারও হাত নেই। এজন্য অনেকে গরিব মারার বাজেট বলছেন। তবে, আমরা গরিববান্ধবসহ দেশের সাধারণ জনগণকে গুরুত্ব দিয়েই বাজেট তৈরি করেছি।

‘মেড ইন বাংলাদেশ’ কনসেপ্টটা এগিয়ে নিতে চাই

বাংলাদেশে যেসব ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদিত হয় তা বিদেশ থেকে আমদানিতে নিরুৎসাহিত করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত ইলেকট্রনিক্স পণ্য দেশ থেকেই কিনতে হবে।

মুস্তফা কামাল বলেন, দেশের ভেতরে যেসব পণ্য উৎপাদিত হয়, সেগুলো যদি আমাদের ব্যবহারে লাগে তাহলে উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করা হোক। এসব পণ্য বিদেশ থেকে আনা আমরা ভালোভাবে দেখছি না। এগুলো দেশ থেকেই কিনতে হবে। বিদেশ থেকে এসব পণ্য আনার চেষ্টা যেন না করা হয়, সে বিষয়ে আমরা নিরুৎসাহিত করছি। আমরা এভাবেই ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ কনসেপ্টটা এগিয়ে নিয়ে যাব।

অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, এ অর্থবছরে অনেক চড়াই-উৎরাই আসবে। তবে এবারের বাজেট বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনীতি আগের তুলনায় অনেক শক্তিশালী হবে।

মহামারি করোনার কারণে প্রথা ভেঙে ২০২০-২১ অর্থবছরের ভার্চুয়ালি বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে সীমিত পরিসরের পাশাপাশি ভার্চুয়ালি বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন করা হয়। অর্থাৎ তিন বছর পর আজ (শুক্রবার) স্বাভাবিক নিয়মে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন হলো।

এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের এটি চতুর্থ বাজেট। আর বাংলাদেশের জন্য ৫১তম। পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ২০তম বাজেট হলেও ২০০৮ সাল থেকে বর্তমান সরকার টানা বাজেট দিয়ে যাচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, এনবিআরের চেয়ারম্যান, অর্থ সচিব, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা।

এসআই/এমএআর/