পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার বৈধতা দেওয়া রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক— তিন ভাবেই অগ্রহণযোগ্য, যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

শুক্রবার (১০ জুন) রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে ‘জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩, সিপিডির পর্যালোচনা’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সংস্থাটি এসব তথ্য জানিয়েছে। এ সময় সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানসহ বিভিন্ন গবেষক উপস্থিত ছিলেন।

এক প্রশ্নের জবাবে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এর আগেও দেখা গেছে বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু খুব কমসংখ্যকই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছে। এবার পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। এটা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক— তিন ভাবেই অগ্রহণযোগ্য। এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। যারা অবৈধভাবে অর্থ নিয়ে গেছেন তারা আইন ভঙ্গ করেছেন। আবার তাদেরকেই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এটা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

পি কে হালদারের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এই ঘোষণার পর বিদেশে পালিয়ে থাকা কেউ একজন যদি কর দিয়ে টাকা নিয়ে আসতেন তাহলে কী করা যেত? তবে এ সুযোগ খুব একটা কাজে আসবে না বলে মনে করেন তিনি। বরং ভবিষ্যতে টাকা আরও পাচার হওয়ার প্রবণতা তৈরি হবে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ সময়ে কেউ টাকা দেশে ফেরত আনবেন না।

অন্যদিকে, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন তার উপস্থাপনায় বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে আলোচিত বিষয় হচ্ছে, বাইরে যারা টাকা নিয়ে গেছেন তাদের বিভিন্ন হারে কর দিয়ে দেশে টাকা ফিরিয়ে আনতে পারবেন। তাদেরকে কোনো ধরনের প্রশ্ন করা হবে না। তারা পাচার করা অর্থ বৈধ করতে পারবেন। এই ধরনের উদ্যোগ কর ন্যায্যতার পরিপন্থি এবং অনৈতিক। যারা সৎ করদাতা তাদের নিরুৎসাহিত করা হবে। অন্যদিকে, যারা অবৈধভাবে অর্থপাচার করে বিদেশে নিয়ে গেছেন, তাদেরকে প্রকান্তরে উৎসাহিত করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে দেশে অর্থ ফেরত আসবে না। 

‘যারা দুর্নীতি ও ব্যাংক ঋণের অর্থ বিদেশে নিয়ে গেছেন তাদেরকে আবারও উৎসাহিত করা হয়েছে। এর আগেও কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ বহু দিন ধরে চললেও প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়নি। সেজন্যই আমরা বলছি, এটা একটি ভ্রান্ত ও অনৈতিক পদক্ষেপ।’

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাইরে পাচার হওয়া টাকা করের মাধ্যমে দেশে আনার সুযোগ দেওয়া হলে তা ইতিবাচক হবে না। এটা যারা সৎ করদাতা ও কর ব্যবস্থায় যারা বিশ্বাস করেন তাদের প্রতি স্রেফ চপেটাঘাত। অর্থমন্ত্রী অসুখের লক্ষণ ধরতে পেরেছেন, কিন্তু ওষুধ প্রয়োগের যে ওষুধ দরকার হয় তার কাছে তা পর্যাপ্ত নেই বা ওষুধ জানা নেই অথবা যে মাত্রায় ওষুধের ডোজ দেওয়া দরকার সে মাত্রায় প্রয়োগ করা হয়নি। যেসব চ্যালেঞ্জের কথা বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন সেটির সাপেক্ষে যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা অপ্রতুল বা অপর্যাপ্ততা দেখতে পেয়েছি।

এক প্রশ্নের জবাবে সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, আসলে সম্পদশালী, বড় উদ্যোক্তা, যারা টাকা-পয়সা বাইরে পাচার করেছেন, তাদের সুযোগই বেশি দেখা যাচ্ছে। সেই অর্থে গরিব মানুষের জন্য বর্ধিত হারে সুযোগ-সুবিধা আসেনি প্রস্তাবিত বাজেটে। সবচেয়ে বড় উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী হলো মধ্যবিত্ত। কর ছাড়ের বিষয়টা সেখানে আসেনি। 

সিপিডি বলছে, ব্যক্তি আয়ের ক্ষেত্রে আমরা এক ধরনের চাপ অনুভব করছি। সে কারণে করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তা করা হয়নি। এছাড়া উচ্চ আয়ের ব্যক্তির কর ২৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৩০ শতাংশ করা হয়নি। যেটা কোভিডের সময় কমানো হয়েছিল। এটা হলে করের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে, আর নিম্ন আয়ের মানুষদের একটু হলেও স্বস্তি দিতে পারত। এছাড়া সঞ্চয়ে বেশি পরিমাণ কর রেয়াত দেওয়া হয়েছে যেটা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কোনো কাজে আসবে না। অর্থাৎ দরিদ্র বা নিম্ন আয়ের মানুষের করের ন্যায্যতা দেওয়া হয়নি।

কর্পোরেট কর কমিয়ে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এটা ইতিবাচক। হয়তো ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়তে পারে, ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের সহায়ক হবে। কিন্তু বর্তমানে তা দরিদ্র জনগণের জন্য কোনো কাজে আসবে না। মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপের জন্য আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কর কমানোর কথা বলেছিলাম। আমরা ২৯টি নিত্যপণ্যের উচ্চ কর কমানোর জন্য এর আগে বলেছি। চাল, চিনি ও গমের ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়।

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের বিষয়ে ফাহমিদা বলেন, এ খাতে বরাদ্দ ও বাস্তবায়নের হার কমে যাচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে বাস্তবায়নের হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি বরাদ্দ প্রায় ১ শতাংশ গত ২০ বছর ধরেই দেখছি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মাথাপিছু বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। কৃষির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

অন্যদিকে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ১.৮৯ শতাংশ। পেনশনে বরাদ্দ যোগ করা হয়েছে। যেখানে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে ২১ শতাংশ। অর্থাৎ পেনশন বাদ দিলে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ কমেছে ১৪.৯০ শতাংশ । কারণ, পেনশন দরিদ্রের কোনো কাজে আসে না। 

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে মূল্যস্ফীতিজনিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যস্ফীতিজনিত অভিঘাতগুলো আসছে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের ওপর। এখানে দৃষ্টি দেওয়া উচিত ছিল। ভর্তুকির ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী ঠিক ব্যবস্থাপনা নিয়েছেন। এখানে ভর্তুকি বাড়িয়েছেন। সঙ্গে এটাও বলছেন, তিনি বিদ্যুৎ বা জ্বালানি খাতের মূল্য সমন্বয় না করে থাকতে পারবেন না। তার মানে হচ্ছে, ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি ও তেলে মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা আসতে পারে।

‘আমরা জোরালোভাবে বলতে চাই, এখন যে পরিস্থিতি তাতে জ্বালানির মূল্য বাড়ালে ভোক্তার প্রকৃত আয়কে আরও কমিয়ে দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে জ্বালানি সাশ্রয়ে গুরুত্ব দিয়ে, আরও কিছু দিন অপেক্ষা করে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট দেখে, জ্বালানি তেলের ওঠা-নামার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে অন্তত ছয় মাস পর মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি অর্থমন্ত্রী বিবেচনা করবেন।’

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বর্তমান চড়া মূল্যের বাজারে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে রাখার যে প্রাক্কলন করেছেন তা বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই। সরকারি হিসাবেই এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম বাড়ছে। কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বাড়ছে।’

আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমে যাবে সে বিষয়ে বাজেটে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বাজেটে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির হিসাব কীভাবে এলো, এটা কীভাবে কমবে তা বলা হয়নি।

প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তার কোনো কৌশল বাতলে দেননি তিনি। এছাড়া আগামী বছরে নির্বাচন। বাজেটে নির্বাচনমুখী কিছু দেখা গেল না। প্রস্তাবিত বাজেটে নারীদের জন্যও বরাদ্দ কমেছে। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ কমেছে। এ দুই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।

‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’— প্রতিপাদ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে। নতুন এ বাজেট প্রস্তাবে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে রাখার কথা বলা হয়েছে।

আরএম/এমআই/