এস কে সুর ও শাহ আলমের ব্যাংক হিসাব তলব
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এস কে) সুর চৌধুরী ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমসহ তাদের স্ত্রীদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সোমবার (২২ ফেব্রুয়ারি) তাদের সব ধরনের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে এনবিআর।
চিঠিতে সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও তার স্ত্রী সুপর্না সুর চৌধুরীর এবং বর্তমান নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম, তার দুই স্ত্রী শাহীন আক্তার শেলী ও নাসরিন বেগমের সঞ্চয় হিসাব, চলতি হিসাব, ঋণ হিসাব ও বিদেশি মুদ্রার হিসাব, ক্রেডিট কার্ড, ভল্ট, সঞ্চয়পত্র, ডিপোজিট স্কিম ও বিও (বেনিফিসিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্টসহ সব ধরনের হিসাব তথ্য চাওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
চিঠিতে ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে হালনাগাদ তথ্য বিবরণী সাত কার্যদিবসের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে পূর্বে বন্ধ হয়ে যাওয়া হিসাবের তথ্য চেয়েছে এনবিআর।
এর আগে, ঘুষের বিনিময়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য চাপা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে বিষয়টি তদন্তে উচ্চ পর্যায়ে কমিটি গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি তদন্ত করতে ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠায় গত ৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থেকে নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
জানা গেছে, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মতো একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। যাদের সহযোগিতা করেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। ঘুষের বিনিময়ে গুরুতর অনিয়মে সহায়তা করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার আরও বেশ কিছু কর্মকর্তা।
আদালতে ১৬৪ ধারায় ঘুষ কেলেঙ্কারির স্বীকারোক্তি দেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান। অনিয়মের অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরাও।
পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, একাধিক ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী পিপলস লিজিংয়ের আর্থিক ভীত ধ্বংস করে দিয়েছে। জবানবন্দিতে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাটে জড়িত হিসেবে শামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটের পরিচালক (অর্থ) আরেফিন শামসুল আলামিন, প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর ও সাবেক জিএম (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক) শাহ আলমের নাম উল্লেখ করেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া উজ্জ্বল কুমার নন্দীর পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে সোমবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আতিকুল ইসলামের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদও প্রচার হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কেন ঘুষ দেওয়া হয়েছে- এর বর্ণনা দিয়ে উজ্জ্বল কুমার নন্দী আদালতে বলেন, পিপলস লিজিংয়ের ডিপোজিট ও ধারের ওপর সুদ ১১১ কোটি টাকা বেশি দেখিয়ে সাবেক চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেমসহ ওই সময়ের পরিচালকরা তা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিজেরাই নিয়েছিলেন। ফলে এ সময়ে সম্পদ বেশি দেখানো হয়েছিল ৩০৯ কোটি টাকা ও দায় কম দেখানো হয়েছিল ৮৮৭ কোটি টাকা। এসব অপকর্ম ঢাকতে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর অডিটের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর, সাবেক জিএম (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক) শাহ আলমসহ অন্যদের এক কোটি টাকা করে সাড়ে ছয় কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কিছু ভিআইপি ব্যক্তির জন্য মূলধন উপহার দেওয়া হয়েছিল মর্মে রেকর্ডপত্রে উল্লেখ রয়েছে। ‘হুসা ভাসি’ প্রতিবেদনে এ বিষয়টি স্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে।
এর আগে, আদালতে পি কে হালদারের অন্যতম সহযোগী ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হকের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রাশেদুল হক। এর আগে দুদক তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়।
গত ২ ফেব্রুয়ারি রাশেদুল হক আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে দিত রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমকে প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা করে দেওয়া হতো। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি ‘ম্যানেজ’ করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী।
এসআই/আরএম/এফআর