চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে হাইড্রোজেন পার অক্সসাইডের মিস হ্যান্ডেলিংয়ের কারণে। আইসিডির এ দুর্ঘটনায় অন্তত ১১০ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১ হাজার ৩৪ কোটি (ডলার প্রতি ৯৪ টাকা ধরে) টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।

বুধবার (২০ জুলাই) রাসায়নিক ও বিপজ্জনক পণ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শিল্প নিরাপত্তা : চট্টগ্রামের ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এসময় উপস্থিত ছিলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রতি দুদিনে একটি করে শিল্প দুর্ঘটনা ঘটছে। সেই জায়গাটিতে নজর দিতে হবে। শিল্প নিরাপত্তার বিষয়টি শুধু গার্মেন্টস ভিত্তিক নয়, এটি শিল্প নিরাপত্তার বিষয়।

তিনি বলেন, গত ২ জুন সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর দুর্ঘটনায় আরেকটি নতুন স্তর সামনে এসেছে। এটিকে শুধু কন্টেইনার হিসেবে দেখলে হবে না। এর ভেতরে রসায়নিক পণ্যের যে সাপ্লাই চেইন রয়েছে, তার নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে আমরা ভেতরে গিয়ে দেখিছি, এখানে বিপজ্জনক ও রসায়নিক চেইনে নিরাপত্তা সংকট রয়েছে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, চট্টগ্রামের কনটেইনার ডিপোর দুর্ঘটনায় ৫১ জন মারা গেছে। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো আগুন নেভাবে গিয়ে ১২ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী মারা যান। ডিপোর দুর্ঘটনায় ১১০ মিলিয়ন ক্ষতি হয়েছে। ডলারে মূল্য ৯৪ টাকা ধরা হলে টাকার অংকে মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।

ডিপোতে ৬শ কর্মী কাজ করে, তবে এতে প্রতিনিয়তই ১২০০-১৩০০ লোকের যাতায়াত— উল্লেখ্য করে তিনি জানান, ডিপোর স্টোরেজে ৬৩০০ কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতা ছিল। এর মধ্যে দুর্ঘটনার সময় ৪১৩৩ কান্টেইনার ছিল। অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ ব্যবহার ছিল। ৪ হাজার কন্টেইনারের মধ্যে ৮৬৭টি কন্টেইনারে রপ্তানি পণ্য ও ৩ হাজার খালি কন্টেইনার ছিল। আর হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের ২৭টি কন্টেইনার ছিল। সেই কন্টেইনার থেকে আগুনের সূত্রপাত্র। কিন্তু প্রতিষ্ঠানে এ রসায়নিক দ্রব্যের আগুন নেভানোর কোনো যন্ত্রপাতি ছিল না ডিপোতে।

শুধু তাই নয়, ফায়ার সার্ভিসের কাছেও রসায়নিক দ্রব্য থাকার সঠিক তথ্য ছিল না। তাই দুর্ঘটনাটি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই ডিপো ২০১১ সাল থেকে কাজ করছে, বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষ্ঠানটিকে সাধারণ পণ্য মজুদ রাখার অনুমোদন ছিল। কিন্তু তাদের কাছে দুই ধরনের পণ্যের অনুমোদন ছিল। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে সাধারণ পণ্যের অনুমোদন আর রসায়নিক পণ্যের অনুমোদন। কিন্তু তাদের কাছে রসায়নিক পণ্যের মজুদের অনুমোদন ছিল না। ফলে আগুন লাগার পর প্রতিষ্ঠান কিংবা ফায়ার সার্ভিস কারও কাছে রসায়নিক পণ্য নেভাতে যে যন্ত্রপাতি লাগে তা ছিল না। আকার ভয়বহ ধারণ করেছে।

২০১৪ সালের পর থেকে কেমিক্যাল রিলেটেড কারখানায় দুর্ঘটনা বাড়ছে উল্লেখ্য করে মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশ শিল্পায়ন হচ্ছে। সুতরাং কেমিক্যাল ব্যবহার ও কারখানা বাড়বে। ফলে রসায়নিক পণ্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হবে। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা আরও বাড়ছে।

সংস্থাটি মনে করে, বাংলাদেশে ক্রমাগত শিল্পায়নের পাশাপাশি রাসায়নিকের ব্যবহারও বাড়ছে। বিভিন্ন কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে কেমিক্যালও ব্যবহৃত হচ্ছে। শিল্পায়নের এ উন্নতি রাসায়নিক দুর্ঘটনা বাড়াতে পারে। এমন অবস্থায় রাসায়নিক উৎপাদন, সংরক্ষণ ও পরিবহনে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ের চাহিদার কারণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে শিল্পায়নের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশও ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের অঞ্চল গড়ে তুলেছে। এগুলো শিল্পায়নের বড় ভূমিকা রাখবে। সে জন্য ক্রমান্বয়ে যখন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। স্বল্প উন্নত দেশ থেকে আমরা উত্তোলন ঘটাচ্ছি।

সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ডিপোর ২৭টি কনটেইনারে বিপজ্জনক রাসায়নিক হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল, যার মধ্যে ১৫টি বিস্ফোরিত হয়েছে। রাসায়ানিকের তথ্য না জানা এবং সেই ধরনের প্রস্তুতি না থাকায় সেখানে ১২ জন অগ্নিনির্বাপক কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন।’

এসময় জনবসতির বাইরে এমন রাসায়নিক হ্যান্ডেলিংয়ের ব্যবস্থা করা, রাসায়নিক সম্পৃক্ত সব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়, ডিপোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম রাখা, রাসায়ানিক থাকা ডিপোকে রেড ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে সিপিডি।

এমআই/এসএম