বাজারে খোলা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬৫ টাকায়। একই চাল প্যাকেটজাত করে বিক্রি করা হচ্ছে ৭৫ থেকে ৭৮ টাকায়। একইভাবে খোলা ১১০ টাকার সুগন্ধি চাল প্যাকেট করে বিক্রি করা হয় ১৪০ টাকায়।

এভাবেই খোলা চালের চেয়ে প্যাকেটজাত চালের কেজি ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে বাজারে বেড়ে যাচ্ছে খোলা চালের দরও। প্যাকেটজাত পণ্যের দাম কারা বাড়াচ্ছে? সুপারশপ, উৎপাদনকারী নাকি সরবরাহকারী- এ নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক।

একে অপরের দোষারোপ করলেও আসলে দায় কার? কে দাম বাড়াচ্ছে? এ তথ্য খুঁজতে উৎপাদক, সরবরাহকারী  ও সুপার শপের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

মঙ্গলবার অধিদপ্তরে সভায় প্যাকেটজাত নিত্যপণ্যের (চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, ডাল, লবণ ইত্যাদি) মূল্যের বিষয়ে নানা আলোচনা হয়।

সুপারশপের প্রতিনিধিরা দাবি করেন, তারা পণ্যের দাম বাড়ান না, বরং উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, সে দামেই বিক্রি করেন। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগসাজশে সুপারশপগুলো প্যাকেটজাত পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে- এটা ঠিক নয়। তাদের দাবি, পণ্যের দাম বাড়ায় উৎপাদনকারীরা

এ সময় সুপারশপের প্রতিনিধিরা দাবি করেন, তারা পণ্যের দাম বাড়ান না, বরং উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, সে দামেই বিক্রি করেন। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগসাজশে সুপারশপগুলো প্যাকেটজাত পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে- এটা ঠিক নয়। তাদের দাবি, পণ্যের দাম বাড়ায় উৎপাদনকারীরা।

তবে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বলছে, দাম তারা নির্ধারণ করে না। এটি ঠিক করে সরকারের বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। এর দায় সরকারের ওপর বর্তায়। একইসঙ্গে সম্প্রতি পণ্যের দাম বাড়ার বিষয়ে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিকে দায়ী করে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

তারা জানায়, আমদানি পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহে খরচ বেশি। এ কারণেই পণ্যের দাম বাড়ছে। তবে সব পক্ষ সমন্বয় করে কাজ করলে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।     

সুপারশপের প্রতিনিধি স্বপ্নের হেড অব সাপ্লাই চেইন কর্মকর্তা তমাল পল বলেন, আমরা দাম বেশি নিচ্ছি, এটা শুধু বলা হচ্ছে। কিন্তু আটা, চিনি, চাসহ প্রায় তিনশর বেশির পণ্যে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছি। এসব পণ্য বাজারের তুলনায় কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে, এটিও দেখতে হবে।

তিনি বলেন, সুপারশপের ভাড়া বেশি। আমরা পণ্যের মান ঠিক রাখতে গিয়ে এসিসহ বিভিন্ন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ব্যবহার করি। এরও খরচ আছে। একটি আউটলেট করতে তিন কোটি টাকা খরচ হয়। সাধারণ দোকানের তুলনায় সুপারশপে পরিচালন ব্যয় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি। এসব বিবেচনায় নিতে হবে।

তমাল বলেন, আমরা অতিরিক্ত ব্যবসা করছি- এটা নয়। লাভ-লোকসান সমন্বয় করেই ব্যবসা করছি। আর প্যাকেটের মূল্য নির্ধারণে আমাদের কোনো হাত নেই। উৎপাদনকারীরা যে রেটে আমাদের দেয়, আমরা সেই রেটেই বিক্রি করি। মোড়কের গায়ে লেখা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে কম দামে বিক্রি করছি।

সুপারশপে পণ্য বিক্রির ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার হলে দাম আরও কমে যাবে বলে জানান এ খাতের ব্যবসায়ীরা। 

সুপারশপ স্বপ্নের প্রধান ব্যবসায়িক কর্মকর্তা মাহাদী ফয়সাল বলেন, বলা হচ্ছে, আমরা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগসাজশে প্যাকেটজাত পণ্যের দাম বাড়াচ্ছি। তবে এর কোনো সুযোগ নেই। আমরা এমন কোন কাজের সঙ্গে জড়িত নই। এ থেকে দায়মুক্তি চাই। অন্যথায় এটি আমাদের ব্যবসার ওপর প্রভাব ফেলছে।

উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, এসব পণ্যের দাম উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বাড়ায় না। সরকার (ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন) নির্ধারণ করে দেয়। সুতরাং এর দায় সরকারের ওপর বর্তায়।

বিতর্কিত মিনিকেট চালের বিষয়ে প্রাণ–আরএফএলের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (ব্যবসা পরিচালন) নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, অভিযোগ আছে, মোটা চাল কেটে মিনিকেট চাল বানানো হয়। কিন্তু চাল ছেঁটে মিনিকেট চাল বানানোর এমন কোনো যন্ত্র দেশে নেই। মিনিকেট একটি ব্র্যান্ড, এটি বাজারে অনেকদিন ধরে আছে। এখন এটি বন্ধ করা হলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, মধ্যবিত্তরাও এখন সুপারশপে ঝুঁকছেন। তাই এখন সময় এসেছে দামের বিষয়টি সমন্বয় করার। পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে সরকার। আর এটা ঠিক হয় আমদানি এলসির খরচ, উৎপাদন ব্যয়, কাঁচামালের মূল্য সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে। এখন কত শতাংশ লাভ করবে- এটা নির্ধারণ করতে দিতে পারে সরকার।

উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের এ উপদেষ্টা বলেন, মিলে যদি সুগন্ধি চাল ১২০ টাকা কেজি হয় তাহলে খুচরায় কেন ১৫০ টাকা হবে? আমরা সব পক্ষ এক সঙ্গে কাজ করলে এটা সমন্বয় করা সম্ভব।

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ১২০ টাকার খোলা চিনিগুঁড়া চাল প্যাকেটজাত করে ১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়, তখন খোলা চালেরও দাম বেড়ে যায়। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, প্যাকেটজাত চিনিগুঁড়া চালে ২৯ শতাংশ, ডিমে ২৬ শতাংশ লাভ  করা হচ্ছে। খোলা চালে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ লাভ করা হচ্ছে। এত লাভ কেন? এটি অবশ্যই কমাতে হবে। ৫৮ টাকার চাল ৭৮ টাকা বিক্রি করবেন এটা মেনে নেওয়া যাবে না।

তিনি বলেন, উৎপাদনকারীরা বলছে ট্যারিফ কমিশন দাম নির্ধারণ করে দেয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটা নির্দেশনা দেওয়া আছে চালের দাম কত হবে। এখন প্যাকেটজাত চালের দাম কত হবে- এটি নিয়েও কাজ করা দরকার। আমরা শিগগিরই কৃষি, খাদ্য, বাণিজ্যসহ ট্যারিফ কমিশনকে সঙ্গে নিয়ে আলোচনা করব। গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় পণ্যের দাম নিয়ে কাজ করছে। তথ্য সংগ্রহ করছে। কারা দাম বাড়ায়- বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আমরা সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলছি। সতর্ক করছি। এরপর আমরা ব্যবস্থা নেব।     

কঠিন সময় যাচ্ছে। সবার সহযোগিতায় সমন্বয় করে কাজ করা হবে। যতটুকু সম্ভব লাভ কম করে এ কঠিন সময় মোকাবিলা করার আহ্বান জানান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

এসআই/আরএইচ