চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ দরকার বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।

মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘দেশীয় বিনিয়োগে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রতিমন্ত্রী এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছে দৈনিক ইত্তেফাক।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, বন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে সরকার চিন্তা করে বসে নেই, পরিকল্পনা করেছে, পরিকল্পনা এখন বাস্তবায়ন করছে। আগামী ২০২৬ ও ২০২৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের চিত্র পাল্টে যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরকে সিঙ্গাপুর বানাতে চাই না, তবে আমাদের সিঙ্গাপুর হবে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর।

গ্লোবাল টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান, এফবিসিসিআইয়ের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক ও পোর্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রধান অঞ্জন শেখর দাশ, এটিএন বাংলার নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন, বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজন বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

প্রবন্ধ উপস্থাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের বন্দরগুলোর কনটেইনার ও পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের তুলনা করলেই বন্দরের গুরুত্ব বোঝা যায়। সমুদ্রপথে দেশে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ৯৩ শতাংশই হ্যান্ডলিং হয় এই বন্দর দিয়ে। আর কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয় ৯৮ শতাংশ। চট্টগ্রাম বন্দর শুধু প্রধান বন্দর নয়, কার্যত এককভাবে সমুদ্রপথে দেশের আমদানি-রপ্তানির বেশিরভাগই হ্যান্ডলিং হচ্ছে এই বন্দর দিয়ে। 

বন্দরের মূল সংস্কার ও আধুনিকতার পথে যাত্রা শুরু হয় মূলত এই শতকে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুমোদন হওয়া নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বাস্তব রূপ পায় ২০০৭ সালে। পাঁচ জেটির ৯৫০ মিটার লম্বা সবচেয়ে বড় এই টার্মিনালটি দিয়ে এখন বাণিজ্যের চাপ সামাল দেওয়া হচ্ছে। 

তবে ২০০৭ সালের পর নতুন টার্মিনাল চালু না হওয়ায় গত ১৪ বছরে তিনটি টার্মিনালের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। এসব টার্মিনালে সক্ষমতার চেয়ে বেশি কনটেইনার ও পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে। এজন্য নিয়মিত সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বলা হয়, সংস্কার কার্যক্রমের বড় উদাহরণ কর্ণফুলী নদীর বন্দর চ্যানেলে তুলনামূলক বড় আকারের জাহাজ ভিড়ানোর উদ্যোগ। দেশ স্বাধীনের পর এই বন্দর জেটিতে ১৬০ মিটার লম্বা ও সাড়ে সাত মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো হতো। ধারাবাহিকভাবে তা বেড়ে এখন ১৯০ মিটার লম্বা এবং সাড়ে নয় মিটার জাহাজ ভিড়ানোর উপযোগী করা হয়েছে। সামনে ড্রাফট ১০ মিটারে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ বাড়ার চিত্র আছে বন্দরের পরিসংখ্যানে। যেমন- চট্টগ্রাম বন্দরে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত গড়ে প্রতি বছরে ১৮ লাখ টিইইউএস কনটেইনার পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে। পরের পাঁচ বছরে (২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২) এই সংখ্যা বেড়ে বছরে গড়ে ২৮ লাখ টিইইউএস কনটেইনারে উন্নীত হয়েছে। অর্থ্যাৎ পাঁচ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি ৪৬ শতাংশ।

কনটেইনার ছাড়াও বাল্ক পণ্য হ্যান্ডলিংও বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত গড়ে প্রতি বছরে ৩ কোটি ৭৭ লাখ টন বাল্ক পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে। পরের পাঁচ বছরে (২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২) পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ বেড়ে বছরে গড়ে ৭ কোটি টনে উন্নীত হয়েছে।

জাহাজ আগমনের হারও বেড়েছে। ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত গড়ে প্রতি বছরে ২৫৯২টি জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে। পরবর্তী পাঁচ বছরে এই সংখ্যা বেড়ে গড়ে বছরে ৩৯৪২টিতে উন্নীত হয়েছে।

গত বছর এই বন্দর দিয়ে ১১ কোটি ৬৬ লাখ টন পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে। কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩২ লাখ টিইইউএস।

দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যও বেড়ে চলেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৯ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৫২ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে গত অর্থবছরে আমদানি-রপ্তানি মিলে বৈদেশিক বাণিজ্যের আকার ছিল ১৪১ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের আকার ছিল ১০৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে গত অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্য ৩৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ভার বহন করছে চট্টগ্রাম বন্দর।

এই বাণিজ্য বাড়ার কারণ দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি। বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে বিশ্ব। আমরাও এর বাইরে নই। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিলাসপণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেছে সরকার। সে কারণে সামনে হয়তো প্রবৃদ্ধি কমবে এসব পণ্যের। তবে তা সাময়িক। বন্দরের ওপর চাপ কিন্তু সে অর্থে কমবে না।

চাপ সামাল দিতে এক যুগের বেশি সময় ধরে বন্দর সংস্কার কার্যক্রম চলছে। কনটেইনার ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি যেটি সিটিএমএস নামে অভিহিত তা চালু হয়েছে। নতুন নতুন অ্যাপ্লিকেশন যুক্ত হচ্ছে সিটিএমএসে। জাহাজ থেকে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য গ্যান্ট্রি ক্রেন সংগ্রহ করা হয়েছে।

আবার পেপারলেস ট্রেডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এই বন্দর। এর ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ইলেকট্রনিক ডেলিভারি যুক্ত হয়েছে। অর্থ্যাৎ ঘরে বসে অনলাইনে ইলেকট্রনিক ডেলিভারি পাচ্ছেন গ্রাহকেরা। এতে জাল ডেলিভারি শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।

চাহিদার তুলনায় জেটির সংখ্যা কম থাকায় আগে বন্দর দিয়ে জটের মুখে পড়তে হতো। করোনার শুরুর দিকেও জটের মুখে পড়েছিল এই বন্দর। তবে বিশ্বের বড় বন্দরগুলোর তুলনায় চট্টগ্রাম খুব দ্রুত তা সামাল দিয়েছে। বন্দরের দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। তবে অপ্রতুল জেটি নিয়ে বন্দর বেশিদিন ভার বইতে পারবে না। এজন্য দরকার নতুন জেটি ও টার্মিনাল।  

অন্তবর্তীকালীন চাপ সামাল দিতে পতেঙ্গায় একটি টার্মিনাল নির্মাণ করেছে বন্দর। প্রায় শেষের দিকে রয়েছে টার্মিনালের নির্মাণকাজ। এই টার্মিনাল চালু হলে কিছুদিন চাপ মোকাবিলা করা যাবে। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পণ্য পরিবহনের চাপ বাড়বে। এই টার্মিনাল দিয়ে ২০২৬ সাল পর্যন্ত কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের চাপ মোকাবিল করতে হবে। এটাই বন্দরের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, পুরোনো জেটিগুলো বেশিদিন ব্যবহারের সুযোগ নেই। এরইমধ্যে জোয়ারের পানি ইয়ার্ডে উঠে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। আগামী দিনে আরও বড় ধরনের প্রভাব তৈরি করতে পারে। যেটি থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে নতুন টার্মিনাল নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে করতে হবে।

গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে বন্দরে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি কনটেইনার ব্যবস্থাপনায় নতুন নতুন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু হয়েছে। এসব কারণে বন্দরের সেবার মান বেড়েছে। জেটি ও বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের সময় কমে এসেছে। যেমন- কনটেইনার ইন্ডেন্ট, পণ্য খালাসের জন্য কাভার্ড ভ্যান বন্দরে প্রবেশ, কনটেইনার লোকেশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমদানিকারকের মোবাইলে চলে যাচ্ছে।

তবে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন, নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন ধারাবাহিক রাখতে হবে। তাহলে সেবার মান আরও বাড়বে। বর্তমানে বন্দর ইয়ার্ড-জেটিতে পণ্য খালাসের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা বিশ্বে নেই। এটি বন্দর ব্যবস্থাপনায় সহজ কাজ জটিল করে তুলছে। এই পদ্ধতি থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে আসতে হবে। সেজন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নীতি-সহায়তা প্রণয়ন করতে হবে।

এমআই/জেডএস