ফাইল ছবি

দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতির কারণে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা। এমন পরিস্থিতিতে অর্থ জমানো তো দূরের কথা, অনেকে ব্যাংকে থাকা টাকা তুলে খাচ্ছেন। ফলে ব্যাংকগুলোতে কমে গেছে আমানত। বিপরীতে বাড়ছে ঋণের চাহিদা।  

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ব্যাংকগুলোতে আমানত কমেছে দুই হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে আমানত বেড়েছিল ১৪ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের প্রথম দুই মাসে ব্যাংকের আমানতের যেখানে এক শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি।  

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহামারি করোনার সময় যখন ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমার কথা, তখন বেড়েছিল। আবার এখন বাড়ার কথা, কিন্তু কমছে। আমানত কমে যাওয়ার জন্য মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকে নিম্নমুখী সুদহারকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

এদিকে গত কয়েক বছরে তলানিতে নেমে যাওয়া অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ‘বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি’ ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। অর্থাৎ যখন আমানতে নেতিবাচক অবস্থা তখনই বেড়েছে ঋণের চাহিদা।
 
ব্যাংকাররা বলছেন, একদিকে আমানত কমে যাচ্ছে অন্য দিকে ঋণ চাহিদা বাড়ায় কিছু ব্যাংক অর্থ সংকটে পড়েছে। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে প্রতি দিনই রেপো ও বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় ধার নিচ্ছে। এ সংকট সৃষ্টির অন্যতম কারণ হলো ব্যাংকগুলো কাঙ্ক্ষিত হারে আমানত পাচ্ছে না। 

আরও পড়ুন : প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

ব্যাংকের আমানত কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা আরও কমে যাবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে বিনিয়োগে। এমনিতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা শিথিলতার কারণে গত দুই বছরে ব্যাংকের ঋণ আদায় বাড়েনি। এর ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এর ওপর আমানত প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা আরও কমে যাবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কয়েকটা কারণে ব্যাংকের আমানত কমছে। এর মধ্যে প্রধান কারণ মূল্যস্ফীতির চাপ। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে আমানত রাখার সুযোগ কমে গেছে। এছাড়া যে হারে ব্যাংকগুলো আমানতের ওপর সুদ বা মুনাফা দিচ্ছে তাতে আমানতকারীদের পোষাচ্ছে না। অর্থাৎ এখন আমানতের ওপর যদি ব্যাংক ৬ শতাংশও সুদ দেয়, সেখানে আমানতকারীরা পান মাত্র ৪ শতাংশ, বাকি দুই শতাংশ বিভিন্ন চার্জ ও ভ্যাট-ট্যাক্সে চলে যায়। এই সুদ দিয়ে মূল্যস্ফীতি কাভার করে না। এসব কারণেই আমানত কমছে।

তবে এখনই চিন্তার কারণ নেই জানিয়ে সাবেক ব্যাংকার নূরুল আমিন বলেন, এক-দুই প্রান্তিকে আমানত কমলেই চিন্তার বিষয় নয়। কারণ ব্যাংকগুলোর পর্যাপ্ত মূলধন আছে, এছাড়াও অনেকে বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করে রেখেছে। এছাড়া এডিআর রেশিও ( আমানত-ঋণ হারের ব্যবধান) ঠিক রাখতে গিয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আমানত ব্যাংকগুলোর কাছে অলস পড়ে থাকে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে আমানত কমতে থাকলে এটা ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি এখন ৯ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বরে তা ছিল ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। এ অবস্থা ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে হিসাব করলে ব্যাংকে টাকা রাখা লোকসান বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।  

আরও পড়ুন : ‘দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি যাতে না হতে হয় সেজন্য প্রস্তুত থাকুন’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানতের স্থিতি ছিল ১৪ লাখ ৭১ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। সেখানে আগস্ট শেষে স্থিতি নেমেছে ১৪ লাখ ৬৮ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকায়। অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট দুই মাসে আমানত কমেছে দুই হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। সেখানে দুই মাসে নিট ঋণ বেড়েছে পাঁচ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট শেষে বেসরকারি খাতে ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা, যা অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ছিল ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা।

২০২২ সালের আগস্ট মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১৪ দশমিক ০৭ শতাংশ। এর অর্থ হলো ২০২১ সালের আগস্ট মাসের চেয়ে এ বছরের আগস্টে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ব্যাংকিং খাত থেকে ১৪ শতাংশের বেশি ঋণ নিয়েছেন। আগের মাস জুলাইয়ে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

এসআই/এনএফ