>> কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ ৩৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার 

>> আকুর বিল ১৩০ কোটি ডলার

>> রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি ৫১৪ কোটি ২৩ লাখ ডলার 

>> মোকাবিলা করা বড় চ্যালেঞ্জ, বলছেন অর্থনীতিবিদরা

ডলার সংকটের কারণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। এতে করে চাপে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সোমবার (৭ নভেম্বর) এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের আমদানি বিল ১৩০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হলে রিজার্ভ কমে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে।  আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী হিসাবায়ন হলে রিজার্ভের অঙ্ক নেমে দাঁড়াবে ২৬ বিলিয়ন ডলারে। যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার।

আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে করে নতুন এলসি খোলা কমেছে। তবে বাকি বা দেরিতে পরিশোধের শর্তে আগের খোলা এলসির দায় এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমেনি। এই কারণে দিন দিন ডলারের সংকট বাড়ছে। বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে ডলার বিক্রির চাপে কমছে অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক। 

চাপের মুখে অর্থনীতি

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ৩৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার । ৭ নভেম্বর আন্ত-আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিকারী সংস্থা-আকুর (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) আমদানি বিল বাবদ ১৩০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হবে। এতে করে রিজার্ভ নেমে আসবে ৩৪ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারে। আইএমএফের দেওয়া শর্তে হিসাব করলে যা কমে দাঁড়াবে ২৬ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলারে। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন : মূল্যস্ফীতির আগ্রাসন ও দুর্বিষহ জনজীবন 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, রিজার্ভ কমে যাচ্ছে এটা অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এখন আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়। প্রথমে আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। ডলারের রেট একেক সময় একেকটা দেওয়া হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। এখন বাজারের ওপর রেট ছেড়ে দেওয়া উচিত। অর্থাৎ প্রয়োজন মতো রেট দিয়ে ব্যাংকগুলো ডলার কিনবে। এতে করে ১১২ হোক, তা বিষয় নয়। রেমিট্যান্স আনা জরুরি।

আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমদানি বন্ধ করে রিজার্ভ বাড়ানো যাবে না। যেসব পণ্য দরকার, তা আমদানি করতে হবে। তা না হলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।     

গত কয়েক মাসে রিজার্ভ কমে বর্তমান পর্যায়ে নেমেছে। এর আগে ধারাবাহিকভাবে যা বাড়ছিল। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ওই বছরের ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এর পর তা বেড়ে গত বছরের আগস্টে প্রথমবারের মতো ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার হয়। এরপর থেকে গত কয়েক মাস ধরে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে রিজার্ভ কমে বর্তমান পর্যায়ে নেমেছে। এর আগে ধারাবাহিকভাবে যা বাড়ছিল। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ওই বছরের ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এর পর তা বেড়ে গত বছরের আগস্টে প্রথমবারের মতো ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার হয়। এরপর থেকে গত কয়েক মাস ধরে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।

আরও পড়ুন : বৈশ্বিক মন্দা ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি 

আমদানি বেড়ে যাওয়া ও প্রবাসী আয় কমার কারণে দেশে মার্কিন ডলারের চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দিন দিন বাড়ছে দাম। অপরদিকে ডলারের বিপরীতে পতন হচ্ছে টাকার মান। এই কারণে রেমিট্যান্স বাড়াতে ও আমদানি কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

রেমিট্যান্স বাড়া‌তে উদ্যোগ

রেমিট্যান্স বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এখন থেকে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে কোনো ধরনের চার্জ নেবে না ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি রেমিট্যান্স পাঠানোর সুবিধার্থে সপ্তাহের ছুটির দিনেও বিদেশে থাকা এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো খোলা থাকবে। ৬ নভেম্বর ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) যৌথ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এর আগে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজের মতো সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালেও প্রতি ডলারে প্রবাসীরা ১০৭ টাকা পাবেন বলে জানায় বাফেদা। আগে যা ছিল ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা। এ ছাড়া এখন বিদেশ থেকে যেকোনো পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাতে কোনো ধরনের কাগজপত্র লাগছে না। আবার প্রবাসী আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার।

আমদানিতে শর্ত

আমদানি কমাতে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে এলসি খোলার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিতে হচ্ছে। সব ঠিক থাকার পরও কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে দিচ্ছে, এই এলসি খোলা যাবে না। বিশেষ করে গাড়ি, টিভি, ফ্রিজ, ফুল, ফলের মতো পণ্য আমদানিতে অনেক ক্ষেত্রে অনাপত্তি দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার অনেক ব্যাংক ডলার সংকটের কারণে শতভাগ এলসি মার্জিন নিয়েও আমদানি এলসি খুলছে না। তবে আগের খোলা এলসির দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এলসি খোলা ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ কমলেও আমদানির দায় পরিশোধ বেড়েছে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ।

আরও পড়ুন : স্ট্যাগফ্লেশন : বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে? 

এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য অনেক বেড়েছে। ফলে গত কয়েক মাস ধরে আমদানি ব্যয়ে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ঠিক রাখতে গিয়ে প্রচুর ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের এ পর্যন্ত ৫১৪ কোটি ২৩ লাখ ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেখানে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কিনেছিল প্রায় ৭৯৩ কোটি ডলার। ডলার কেনার চেয়ে এখন বিক্রির চাপ বেশি হওয়ায় রিজার্ভ কমছে।

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব হয় আইএমএফের ব্যালান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম ৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট ও মোট হিসাব করে বাংলাদেশ। নিট হিসাবে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ (ইডিএফ) বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেওয়া অর্থ বাদ দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের গ্রস বা মোট হিসাবই প্রকাশ করে আসছে

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব হয় আইএমএফের ব্যালান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম ৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট ও মোট হিসাব করে বাংলাদেশ। নিট হিসাবে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ (ইডিএফ) বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেওয়া অর্থ বাদ দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের গ্রস বা মোট হিসাবই প্রকাশ করে আসছে। সেই হিসাবে ইডিএফের সরবরাহ করা সাত বিলিয়ন ও শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ২০ কোটি ডলার রিজার্ভে দেখাচ্ছে। এ ছাড়া গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডের (জিটিএফ) ২০ কোটি, লং টার্ম ফিন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলের ৩ কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে দেওয়া ৪ কোটি ৮০ লাখ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের (আইটিএফসি) আমানত রিজার্ভে দেখানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে রিজার্ভে যে অর্থ দেখানো হচ্ছে, সেখান থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে বলে মনে করে আইএমএফ।

এসআই/আরএইচ