অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, চলতি অর্থবছরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ঋণ পাওয়া যায়নি। একটি ঋণের বিষয়ে আইএমএফের সাথে আলোচনা চলমান রয়েছে।

আজ (মঙ্গলবার) জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে সরকারি দলের হাবিবর রহমানের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ তথ্য জানান। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উপস্থাপিত হয়।

ওই সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, চলতি অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক থেকে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পাওয়া গেছে। এই ঋণ ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছরে পরিশোধযোগ্য।

এছাড়া অন্য এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত জাপান সরকার ৯২১ দশমিক ৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড় করেছে।

কৃষি ঋণের সুদ মওকুফের কোনো পরিকল্পনা নেই
সংরক্ষিত আসনের সদস্য নাজমা আকতারের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, কৃষি ঋণের সুদ মওকুফের কোনো পরিকল্পনা নেই। এর কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, ব্যাংক আমানতকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে কৃষকদের ঋণ দেয়। আমানতকারীদের ব্যাংকের সুদ দিতে হয় বলে প্রচলিত নিয়মে ব্যাংকের পক্ষে কৃষকদের মাঝে দেওয়া ঋণের সুদ মওকুফ করা সম্ভব হয় না।

গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কর-রাজস্ব কম আদায় হওয়ার তথ্য উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির সৈয়দ আবু হোসেনের প্রশ্নের জবাবে মুস্তফা কামাল জানান, কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী মুদ্রা নীতি ও ব্যয় সংকোচন নীতি ইত্যাদি কারণে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় কিছুটা ব্যর্থ হয়েছে।

সরকার দলীয় সংসদ সদস্য এম আব্দুল লতিফের প্রশ্নের উত্তরে ডলার সংকট কমাতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা সংসদে তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। তিনি জানান, ডমেস্টিক ব্যাংকিং ইউনিটকে (স্থানীয় ব্যাংক) তাদের অফশোর ব্যাংকিং অপারেশন থেকে বৈদেশিক মুদ্রা তহবিল সংগ্রহের প্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে, যা ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।

রমজান মাসে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুরের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখাসহ পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে এ সকল পণ্য ৯০ দিনের বিলম্ব মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থায় আমদানির সুযোগ প্রদান করা হয়েছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। যা ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সহজীকরণের লক্ষ্যে উক্ত দেশের মুদ্রার সঙ্গে লেনদেনের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার বৃদ্ধি পেয়েছে
এম আবদুল লতিফের আরেক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার তৎপূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, টাকার অংকে যা ১২ হাজার ৩৮৫ কোটি ৬৪ লাখ। ২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রয়ের পরিমাণ ১ লাখ ৩ হাজার ৬৫২ কোটি ৮ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৯১ হাজার ২৬৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, করোনার শুরুতে সকল তফসিলি ব্যাংককে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রমের আওতায় বিশেষ সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়। ২০২০ সালে অর্জিত নিট মুনাফার ১% এর বিপরীতে বিশেষ সিএসআর খাতে ব্যাংকগুলোর বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১০৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা এবং এ খাতে ব্যাংকগুলো বিতরণ করে ১০৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা (মোট বরাদ্দের প্রায় ১০০ দশমিক ৪৮)। 

তফসিলি ব্যাংকগুলোর জানুয়ারি-জুন, ২০২২ সময়ে সিএসআর কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে শীর্ষ ব্যয়কারী ১০টি ব্যাংক হলো- ইসলামী ব্যাংক (২০২ কোটি ১৯ লাখ), ডাচ-বাংলা (৩৯ কোটি ৭ লাখ), দি প্রিমিয়ার ব্যাংক (২৯ কোটি ৯৫ লাখ), এক্সিম ব্যাংক (২৮ কোটি ৩৯ লাখ), মার্কেন্টাইল ব্যাংক (২২ কোটি ১৬ লাখ), শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক (২১ কোটি ৬৫ লাখ), আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক (১৯ কোটি ৮১ লাখ), ঢাকা ব্যাংক (১৪ কোটি ৯৬ লাখ), প্রাইম ব্যাংক (১৪ কোটি ৬৩ লাখ) এবং ব্র্যাক ব্যাংক (১৪ কোটি ৪৬ লাখ) টাকা ব্যয় করে।

ময়মনসিংহ-১১ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য কাজিম উদ্দিন আহম্মেদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান চলতি ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ডলার রিজার্ভের পরিমাণ ৩২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন।

পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের আইনগত কার্যক্রম চলমান রয়েছে
সংরক্ষিত মহিলা আসনের লুৎফুন নেসা খানের প্রশ্নের জবাবে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের আইনগত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) পাচারকারী বা পাচারকৃত অর্থের বিষয়ে বিদেশি আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ পুলিশের সিআইডি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থায় তা সরবরাহ করে থাকে। বিদেশে (সিঙ্গাপুর, মালেয়শিয়া, হংকং, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ইত্যাদি) ফ্ল্যাট বা বাড়ি ক্রয় অথবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে অর্থ পাচার বিষয়ক বেশ কিছু মামলা বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তাধীন রয়েছে।

তিনি বলেন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) কর্তৃক পাচার সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু মামলা চলমান রয়েছে। প্রসঙ্গত, অর্থপাচার সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ বা তথ্য প্রাপ্ত হলে বিএফআইইউ আইনের বিধান অনুযায়ী ‘গোয়েন্দা প্রতিবেদন’ প্রণয়ন করে তা সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থায় পাঠিয়ে থাকে।

বিএফআইইউ থেকে গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থা অনুসন্ধান ও তদন্তকার্য সম্পাদন করে প্রয়োজনীয় বিচারিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করে থাকে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের শিডিউলভুক্ত অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করার ঘটনা দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ বিদেশে পাচার করার ঘটনা বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক তদন্ত করা হয়ে থাকে। এছাড়া হুন্ডি বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ পাচার হলে তা বাংলাদেশ পুলিশের সিআইডি কর্তৃক তদন্ত করা হয়ে থাকে।

অর্থপাচার রোধ এবং পাচারকৃত অর্থ বাংলাদেশে ফেরত আনার বিষয়ে সরকার বদ্ধ পরিকর এবং এ লক্ষ্যে সরকারের সকল সংস্থা একযোগে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, অর্থপাচার ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০১২ সালে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ জারি করা হয় এবং পরবর্তীতে ২০১৫ সালে আইনটির বিভিন্ন ধারা সংশোধন করা হয়। আইনের বিভিন্ন ধারা সংশোধনের মাধ্যমে অর্থ পাচার ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের কার্যক্রমকে আরও জোরদার করা হয়।

তিনি বলেন, আইনের বিধান অনুসারে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিদেশে পাচার মানিলন্ডারিং অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনার লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্স পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন দেশের সাথে পারস্পরিক আইনগত সহযোগিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা আইন, ২০১২ জারি করা হয়েছে। ওই আইনের আওতায় অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা প্রদানকল্পে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্ধারণ করা হয়েছে।

এসআর/এনএফ