ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে আসন্ন রমজানে পণ্য ঘাটতির আশঙ্কা করছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই)।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা পরবর্তী রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এমনিতে ডলারের দাম বেড়েছে।  বহির্বিশ্বে সকল শিল্প পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে চাপ পড়েছে রপ্তানিতে। এ অবস্থায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে অর্থায়ন নিশ্চিত করা, এলসি জটিলতা সমাধান, কর সংক্রান্ত জটিলতা দূর করা, কারখানায় গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করাসহ ব্যবসা এগিয়ে নেয় এমন সব খাতে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের (পিইবি) যৌথ উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স)’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন বক্তারা।

এতে সভাপতিত্ব করেন এমসিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বিশেষ অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সেক্রেটারি) মাসুদ বিন মোমেন, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) লোকমান হোসেন মিয়া। 
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের (পিইবি) চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ।

সভাপতির বক্তব্যে সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের চারপাশে একযোগে অনেক সংকট দেখা দিয়েছে। যেমন, ডলার সংকট, বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া, সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি, একটি মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এটি বর্তমান পরিস্থিতিতে জটিলতা তৈরি করেছে।

মূল প্রবন্ধে ড. এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স তৈরিতে ১০টি মানদণ্ড বিবেচনা করা হয়। এগুলো হলো ব্যবসা শুরু করা, জমির সহজলভ্যতা, নিয়ন্ত্রণমূলক তথ্যের সহজলভ্যতা, অবকাঠামো, শ্রম বিধিবিধান, বিরোধ নিষ্পত্তি, সীমান্ত বাণিজ্যের সহজীকরণ, কর পরিশোধ, প্রযুক্তির অভিযোজন ও ঋণের প্রাপ্যতা। এ বছর ব্যবসায় উন্নয়ন সূচকে উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের। ২০২২ সালে ব্যবসা সূচকে উন্নতি ৬১ দশমিক ৯৫ শতাংশ, যেটি আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ছিল ৬১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন উদ্যোক্তা ব্যবসা শুরু করতে গেলে কমপক্ষে ২৩টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মুখোমুখি হতে হয়। এর মধ্যে তাকে ১৫০টি সরকারি বিধি-বিধান মেনে চলতে হয়। বাংলাদেশে এখন কৃষি, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা উদ্যোক্তা হওয়ার চেয়ে ফার্মাসিউটিক্যালস, কেমিক্যাল ও পোশাক খাতের ব্যবসা দেওয়া অনেক সহজ হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ২০২২ সালে এ সূচক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০২১ সালে তা ছিল ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ।

কারখানার জন্য জমি পাওয়ার ক্ষেত্রে জরিপে অংশ নেওয়া ৮৬ শতাংশ ভুক্তভোগী বলেছেন, সরকারি সংস্থাগুলোকে বিপুল পরিমাণ ঘুষ দিতে হয়। দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে তুলনামূলকভাবে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে জমি পাওয়া কিছুটা সহজ। ২০২২ সালে এ সূচকে অবনতি হয়েছে। এ বছর তা ৫৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, ২০২১ সালে যা ছিল ৫৮ দশমিক ৯০ শতাংশ।

সরকারি তথ্য প্রাপ্তিতে গত বছরের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। এ বছর সূচক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ২০২১ সালে তা ছিল ৫৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

১০টি পিলারের মধ্যে ব্যবসা করতে গিয়ে অবকাঠামো নির্মাণে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পেয়েছে। গত বছরের চেয়ে এ খাতে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ২০২২ সালে তা বেড়ে ৭২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, আগের বছরে এ সূচক ৭২ দশমিক ০২ শতাংশে ছিল।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শ্রম বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে শ্রমিকরা ফার্মাসিউটিক্যালস, কেমিক্যাল ও অবকাঠামো নির্মাণ খাত পোশাক ও পরিবহনের তুলনায় অনেক ভালোভাবে কাজ করছে। এ সূচকেও গত বছরের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। ২০২২ সালে এ খাতে সূচক ৭৪ দশমিক ৪০ শতাংশ, ২০২১ সালে তা ছিল ৬৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

ব্যবসা ক্ষেত্রে বিরোধ নিষ্পত্তিতেও উন্নতি হয়েছে ২০২২ সালে। এ বছর এ খাতে সূচক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪ দশমিক ২৪ শতাংশ, ২০২১ সালে তা ছিল ৫৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি হলেও চট্টগ্রাম বন্দরসহ বেশ কয়েকটি বন্দরে জটিলতা এখনও রয়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বাণিজ্য সুবিধা এ বছর সূচকে উন্নতি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ দশমিক ৬১ শতাংশ, ২০২১ সালে তা ছিল ৪৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন চট্টগ্রাম বন্দরে এখনও সময় অনেক বেশি প্রয়োজন হয়।

তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের সূচকেও ২০২২ সালে উন্নতি হয়েছে। এ বছর এ খাতে সূচক ৬০ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০২১ সালে তা ছিল ৫৭ দশমিক ৭০। তবে ২০২২ সালে ব্যবসায়ীদের অর্থায়ন প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ বছর আগের বছরের চেয়ে ঋণ প্রাপ্তির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশেরও বেশি। এ বছর সূচক অবনতি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ২২ শতাংশে। আগের বছরও তা ছিল ৫০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। 

জরিপে অংশ নেওয়া ৮৭ শতাংশ বলছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে বা বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে গেলে তারা অনেক জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন। এজন্য তারা অ-ব্যাংকিং খাত বা এনজিও থেকে ঋণ বা বিনিয়োগ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এ ভোগান্তিতে বেশি পড়েছেন।

অনুষ্ঠানে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, এমসিসিআই সময় উপযোগী একটি পদক্ষেপ নিয়েছে। যেটা দেশ ও ব্যবসা বান্ধব একটা পদক্ষেপ। এটা থেকে উন্নতি করার অনেক কিছু রয়েছে। সেটা চেষ্টা করব। এ প্রতিবেদনটা বিডাকে অনেক সহায়তা করবে।

তিনি বলেন, আমরা আইসিটিতে একটু পরে যাত্রা শুরু করছি। তবে আইসিটি গতিশীল করার জন্য যা করা দরকার সব ব্যবস্থা করব। আশা করছি, আগামী তিন মাসের মধ্যে একটা ভালো অবস্থানে যাব।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, প্রতিনিয়ত দেশের ব্যবসার পরিবেশ বদলাচ্ছে। এ অবস্থায় এমন জরিপ কাজে লাগবে। কেবল ঢাকা চট্টগ্রাম নয় সারাদেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে ৫০ শতাংশ। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে এখনো ঋণ জটিলতা রয়েছে। এটা সমাধান করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে কাজ করছে সরকার। তবে যারা দেশে বর্তমানে আছে, বিনিয়োগ করছে তাদের খবর নিতে হবে। তাদের যদি ভালো সেবা দিতে পারি, তাহলে আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসবে।

তিনি আরও বলেন, লেদার সরকারের ভালো আয়ের উৎস হতে পারে। আমরা খুব স্মার্ট কথা বার্তায় কিন্তু কাজে কিছু নয়। এদিকে মনোযোগ দিতে হবে। এক ট্রিটমেন্ট প্ল্যান নিয়ে সাভারে যা চলল তা এখনো শেষ হয়নি।

এসআই/এসকেডি