ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালনাপর্ষদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঋণ বিতরণে নয়-ছয়ের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ঋণের অর্থের পরিমাণও কম নয়, তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধানে নামে। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে চলা অনুসন্ধান কার্যক্রমে এখনও তেমন কোনো গতি আসেনি।

প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারসহ পরিচালনাপর্ষদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, নামে-বেনামে জনগণের আমানতের অর্থ লুটপাটের অভিযোগ থাকলেও টানা ছয় বছরেও অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি দুদক।

দফায় দফায় অনুসন্ধান টিম পুনর্গঠন ও অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা পড়লেও তা আর মামলায় গড়ায়নি। এর মধ্যে অনুসন্ধান পর্যায়ে নতুন নতুন অভিযোগও যোগ হয়েছে। সর্বশেষ আবারও অনুসন্ধান টিম পুনর্গঠন হয়েছে বলে জানা গেছে।

আগের অনুসন্ধান টিমের প্রধান অবসরে যাওয়ার কারণে নতুন করে টিম পুনর্গঠন হয়েছে। এবার দুদক পরিচালক মো. বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বে টিম গঠিত হয়েছে। টিমের অপর সদস্যরা হলেন- সহকারী পরিচালক সিলভিয়া ফেরদৌস, আতাউর রহমান সরকার ও এস এম রাশেদুল ইসলাম। দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন।

আরো পড়ুন  >> ঋণের ৩০০০ কোটিতে ‘নয়-ছয়’, নিশ্চুপ দুদক!

দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৬ সালে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দুদক উপপরিচালক নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল তিন দফায় অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনের কাছে জমা দেয়। ২০২০ সালের প্রথম দিকে অভিযোগটি পরিসমাপ্তির (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন জমা দিলেও কমিশন তা গ্রহণ করেনি। পরবর্তীতে ওই বছরের মার্চ মাসে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম গঠন করে পুনরায় অনুসন্ধানের নির্দেশনা দিয়েছিল কমিশন। এরপর ২০২১ সালে আরেক দফায় টিম পুনর্গঠন করা হয়েছিল।

অভিযোগের বিষয়ে বলা হয়, হাসান টেলিকম নামের একটি অখ্যাত কোম্পানির নামে ঋণ সৃষ্টি করে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেয় সিকদার পরিবার। এ ঋণের আবেদন, অনুমোদন ও বিতরণ-সবই হয়েছে ২০১৮ সালের শেষের দিকে। যার মধ্যে ১০০ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয় ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে। বাকি ৩৮৫ কোটি টাকা তোলা হয় পরের তিন মাসের মধ্যে। ‘কাগুজে’ কাজের আদেশের বিপরীতে পণ্য সরবরাহের ঋণের আড়ালে ৩৩৫ কোটি টাকা সরিয়ে নেয় আরিফ হাসান, ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনাপর্ষদ এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। বাকি ১৫০ কোটি টাকাও তারা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেন।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাসান টেলিকমকে দেওয়া ঋণের ৬৪ কোটি টাকা সরাসরি জমা হয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক রিক হক সিকদার, সিকদার গ্রুপের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা সৈয়দ কামরুল ইসলাম (মোহন) এবং সিকদার গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠান পাওয়ার প্যাক ও সিকদার রিয়েল এস্টেটের হিসাবে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের একটি তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে পাঠায়।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর প্রথম দফায় হাসান টেলিকমের নামে ১০০ কোটি টাকা ছাড় করে ব্যাংক। সেদিনই ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক রিক হক সিকদারের হিসাবে জমা হয় ২০ কোটি টাকা, সিকদার গ্রুপের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা সৈয়দ কামরুল ইসলামের হিসাবে ১০ কোটি ২৮ লাখ টাকা এবং গ্রুপটির মালিকানাধীন পাওয়ার প্যাকের হিসাবে যায় ১০ কোটি টাকা। বাকি অর্থ দিয়ে আরিফ হাসান নিজের নামে ন্যাশনাল ব্যাংকে বিভিন্ন মেয়াদের আমানতের হিসাব খোলেন।

একই বছরের ২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় আরও ১০০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। এর মধ্যে ৪ ডিসেম্বর রিক হক সিকদারের পশ্চিম ধানমন্ডি শাখার হিসাবে জমা হয় তিন কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১০ ডিসেম্বর সিকদার রিয়েল এস্টেটের হিসাবে জমা হয় ২০ কোটি টাকা। বাকি টাকা আবারও আরিফ হাসানের বিভিন্ন হিসাবে জমা হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে আরও ৬০ কোটি টাকা ছাড় করে ব্যাংক। এ টাকা নগদে উত্তোলন করেন আরিফ হাসান-উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

আরও জানা যায়, ২০১৭ সালে ব্যাংকটির শীর্ষ দুই খেলাপি গ্রাহক ছিল ইপসু ট্রেডিং ও ক্যামব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল। এর মধ্যে ইপসুর কাছে পাওনা ছিল ১৪৫ কোটি টাকা এবং ক্যামব্রিজের কাছে ১৩৫ কোটি টাকা। এসব ঋণ বিতরণ হয়েছিল ২০১৩ সালে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৫ সালেই এসব ঋণ প্রদানে অনিয়ম, ব্যবহার ও সুবিধাভোগী নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ব্যাংকটির নিমতলী শাখায় ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল ইপসু ট্রেডিংয়ের নামে হিসাব খোলার দুই দিন পরই ৪০ কোটি টাকার ঋণ ছাড় করা হয়। এ অর্থ দিয়ে সিকদার রিয়েল এস্টেটের জেড এইচ সিকদার শপিং কমপ্লেক্সের জায়গা (ফ্লোর) কেনেন। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার নিমতলী বাজারের এ শপিং কমপ্লেক্সের প্রতি বর্গফুট জায়গার দাম ১২ হাজার ৮২০ টাকা ধরা হয়, যা বাজারমূল্য অনুযায়ী কয়েকগুণ বেশি ছিল।

এছাড়া ব্যাংকের সীমান্ত স্কয়ার শাখায় ২০১৩ সালের ১৩ মে ক্যামব্রিজ ইন্টারন্যাশনালের হিসাব খুলেই ভবন ক্রয়ের জন্য ১৩২ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করা হয়। পরদিন ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির সভায় তা অনুমোদনও দেওয়া হয়। এরপর ভবনবিক্রেতা ও ব্যাংকের পরিচালক মনোয়ারা সিকদারের অনুকূলে পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই বছরের ২২ মে ৫৫ কোটি, ২৭ মে ৫৫ কোটি এবং ২৮ মে ৪১ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। যার প্রকৃত সুবিধাভোগী সিকদার পরিবার বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অন্যদিকে, ২০১৮ সালে সাদ মুসা গ্রুপের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। এর বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হলেও তা অশ্রেণিকৃত করে রাখা হয়। প্রতিষ্ঠানটি মাইশা গ্রুপের কাছ থেকে গাজীপুরের এক হাজার ৬০০ শতক জমি ক্রয় করে, যার দলিল মূল্য ৩০ কোটি টাকা। তবে ব্যাংক থেকে এ বাবদ নেওয়া হয় ১৫৮ কোটি টাকা। এ জমি দেখিয়ে ঋণের সীমা বাড়িয়ে নেওয়া হয় বলেও অভিযোগ আছে।

২০১৮ সালের ২৯ মার্চ নাফ ট্রেডিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ২৬০ কোটি ঋণ অনুমোদন হয়। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর ঋণসীমা বাড়িয়ে ৬৩০ কোটি টাকা করা হয়। এ অর্থ বিভিন্ন মাধ্যমে জমা হয় সোশ্যাল ইসলামী ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, চট্টগ্রামের বিভিন্ন শাখায়। এসব ঋণে জামানত ছিল না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান মিলেনিয়াম গ্রুপকে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়া খেলাপি ঋণ ছিল এক হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। যা খেলাপি হিসেবে দেখাতে আদালতের স্থগিতাদেশ ছিল। যেখানে ন্যাশনাল ব্যাংক ২০১৬ সালের শেষের দিকে মিলিনিয়াম গ্রুপকে ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ দেয়।

এছাড়া প্রিমিয়ার প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট, হামিদ রিয়েল এস্টেট, আফসার রিয়েল এস্টেট, ফ্রেন্ডস মাল্টি ট্রেড কোম্পানি ও মেসার্স চিটাগাং সিন্ডিকেটের নামে শত কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে। এসব ঋণের প্রক্রিয়ায়ও অনিয়মের অভিযোগ মেলে।

আরএম/জেডএস