রমজানের ইফতারে ফল রাখার চেষ্টা থাকে সব শ্রেণির মানুষের। তবে এ বছর বাড়তি দামের কারণে ইফতারে ফল রাখতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয়ে আছেন নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তরা। 

ডলার সংকট, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং ফল আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্কারোপের কারণে সব ধরনের ফলের দাম এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অনেকেই ফল খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন আর অনেকে সীমিত পরিমাণে কিনছেন।

রমজানকে সামনে রেখে ফলের দাম বেড়েছে আরও। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছেন মানুষ, সেখানে ইফতারে ফল রাখা এবার খুব কঠিন হবে। কেউ যদি ফল রাখেনও সেটি এক ধরনের ‘বিলাসিতা’ হবে বলে মনে করছেন অনেকে।

ফল ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার রোজায় ফলের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকবে। কিন্তু বাড়তি দামের কারণে অনেকে ইফতারের মেন্যু থেকে ফল বাদ দেবেন। গত বছরও রোজায় ফলের পর্যাপ্ত সরবরাহ ‌থাকলেও বিক্রি ছিল কম। এবারও একই চিত্র থাকবে।

রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি ফলের আড়ত বাদামতলী। গত বুধবার (১ মার্চ) ওই বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সব ধরনের ফলের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। রোজা উপলক্ষে গত ১৫ দিনে প্রচুর ফল আমদানি হয়েছে। তবে আমদানি পর্যাপ্ত হলেও দামে কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে দাম আরও বেড়েছে।  

রমজানকে কেন্দ্র করে ফলের দাম বেড়েছে আরও। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছেন মানুষ, সেখানে ইফতারে ফল রাখা এবার খুব কঠিন হবে। কেউ যদি ফল রাখেনও ইফতারের মেনুতে সেটি এক ধরনের ‘বিলাসিতা’ হবে বলে মনে করছেন অনেকে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডলার সংকট, তেল ও জাহাজের কনটেইনার ভাড়া বেড়েছে। ‘বিলাসী পণ্য’ দেখিয়ে রাজস্ব বোর্ড ২০% নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের কারণে গত এক বছর ধরে ফলের বাজার ছিল অস্থির। তবে রোজা উপলক্ষে সরকার ফল আমদানিতে এলসি খোলার সুযোগ দেওয়ায় পর্যাপ্ত ফল এসেছে। আশা করি, রমজানকে কেন্দ্র করে নতুন করে আর দাম বাড়বে না। বর্তমান দামেই কত শতাংশ মানুষ ইফতারে ফল রাখতে পারবেন সেটা নিয়ে সংশয় আছে।

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের কয়েক দফা মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের আকাশচুম্বী দামের কারণে সংসার খরচ বেড়ে গেছে। অথচ আমার বেতন বাড়েনি এক টাকাও। এ অবস্থায় রোজায় সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে, ইফতারের জন্য ফল কিনব কীভাবে?

পাইকারি ও খুচরা বাজারে তুলনামূলক ফলের দাম

ফলের দামের তুলনামূলক চিত্র তুলে আনতে রাজধানীর বাদামতলী, কারওয়ান বাজার, শান্তিনগর, ঝিগাতলা ও হাতিরপুল বাজার পরিদর্শন করেন এ প্রতিবেদক। সব বাজারেই কাছাকাছি মূল্যে পাইকারি ও খুচরা ফল বিক্রি হচ্ছে। 

বাজারে ক্রাউন আপেল ২০ কেজির বক্স বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৯০০ থেকে ৪ হাজার টাকা। সে হিসেবে পাইকারিতে প্রতি কেজি আপেলের দাম পড়ে ১৯৫-২০০ টাকা। খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। গত বছর এর দাম ছিল কেজি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা।

ফুজি আপেলের ২০ কেজির বক্স ৪৩০০-৪৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসেবে প্রতি কেজি ফুজি আপেলের দাম পাইকারিতে ২১৫-২২৫ টাকা। খুচরা বাজারে একই আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা।

মিশরের মাল্টা ১৫ কেজির বক্স পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩৫০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায় (প্রতি কেজি ১৫৬-১৭৩ টাকা)। খুচরা বাজারে এ মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকা।

ইন্ডিয়ান সাদা আঙুর ছোট ক্যারেট (৯ কেজি) ২ হাজার থেকে ২ হাজার ১০০ টাকা, ইন্ডিয়ান সাদা আঙুর বড় ক্যারেট (৯ কেজি) ৩ হাজার ৭০০ থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা এবং ইন্ডিয়ান কালো আঙুর ছোট ক্যারেট ২ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব আঙুর প্রকারভেদে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকায়।

চায়না কমলা (৯ কেজি) পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৭৫০ থেকে ১৮০০ টাকায় (১৯৪-২০০ টাকা প্রতি কেজি)। খুচরা বাজারে প্রকারভেদে এ কমলা বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকা থেকে ২৮০ টাকা। গ্রিন কমলা (২৮ কেজি) পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ২০০ টাকায় (কেজি ১৫০ টাকা)। খুচরা বাজারের একই কমলা বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায়।

রোজায় ইফতারের আরেকটি জনপ্রিয় ফল আনারস। অন্যান্য বছর রসালো দেশীয় এ ফলটি সবার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকলেও এবার এটিরও দাম বেশি। মাঝারি সাইজের একটি আনারস খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১২০ টাকায়। একই আনারস এক বছর আগেও ৪০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। 

কলা (চাম্পা) হালি ৫০ থেকে ৫৫ এবং সাগর কলা ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তরমুজ (মাঝারি) প্রতি কেজি ৯০ থেকে ১১০ টাকা, পেঁপে ৯০-১০০ টাকা, পেয়ারা ৭০-৮০ টাকা, বেদানা ৩৫০-৪০০ টাকা, কুল বরই ৮০-১০০ টাকা কেজি, সফেদা/আতাফল ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের এনায়েত ব্রাদার্সের মালিক এনায়েতুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইফতারে যেসব ফলের চাহিদা বেশি থাকে তার মধ্যে বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়। বিদেশি ফলকে ‘বিলাসপণ্য’ দেখিয়ে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় সব ফলের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। বাড়তি দামের প্রভাব বিক্রিতে পড়েছে। 

তিনি বলেন, ফলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। তারা সংসার চালাবে নাকি বিলাসিতা করে ইফতারে ফল রাখবে? রোজায় শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু সেই দাবি পূরণ না করে এলসি খোলার সুযোগ দিয়েছে সরকার। এজন্য বাজারে পর্যাপ্ত ফল থাকলেও ক্রেতা কম।

এনএম/এসকেডি/ওএফ