করোনার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ জারি করার প্রথম সপ্তাহ শেষ হচ্ছে আজ। এরই মধ্যে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধের মেয়াদ বাড়িয়ে মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সরকারের এবারের কঠোর বিধিনিষেধ নিয়ে দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ তার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ১৬টি পরামর্শ দিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীনের অনুমতিতে ঢাকা পোস্টের পাঠকদের জন্য ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো-

১. করোনা ঠেকাতে লকডাউন। তাতে করোনার সাময়িক প্রকোপ কমল, কিন্তু ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, শ্রমিক, কারিগর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যে ত্রাহি অবস্থা আমরা দেখছি। তাতে আমাদের এ অর্থনীতি লকডাউনের চাপ কতটা নিতে পারবে তা ভাবা দরকার।

 আরও পড়ুন : করোনাকালে বৈশাখের অর্থনীতি

২. লকডাউনে রফতানি শিল্পসহ বেশকিছু জরুরি শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা আছে, ফলে তাদের ক্ষতি কম। কিন্তু নানা পণ্য উৎপাদনকারী অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র পণ্যের উদ্যোক্তা যারা ঈদসহ নানা উৎসবকে ঘিরে তাদের পণ্যের পসরা সাজান, তারা পড়েছেন মারাত্মক বিপাকে। সেইসঙ্গে আছে রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, পার্লার, নানান রকম আইসিটি সম্পৃক্ত সেবা, যারা তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারছেন না। এই সব উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে লক্ষ লক্ষ কারিগর, শ্রমিক কর্মচারী। এসব খাতের উদ্যোক্তাদের পক্ষে  শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন কত দিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? বড় উদ্যোক্তারা যেখানে শ্রমিকের বেতন দেওয়ার জন্য সরকারের সাহায্য নিতে হয়, তাহলে এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা কীভাবে সেই বেতন চালিয়ে যাবেন?

৩. গত বছরের প্রণোদনা প্যাকেজের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের বণ্টন হয়েছে খুব ধীর গতিতে। এখন পর্যন্ত ৭৫ ভাগ এর মত বণ্টিত হয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা সেই সুবিধা পাননি। বিশেষ করে যাদের ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন নেই কিংবা যাদের ব্যবসার ক্ষতি অনেক বেশি হয়েছিল তারা কিন্তু এই প্রণোদনার আওতার বাইরে রয়ে গেছেন। তারা আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। সেই অবস্থায় পণ্য বিক্রি করতে না পারলে এ উদ্যোক্তা এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা কাজ হারিয়ে, আয় হারিয়ে মারাত্মক সংকটে পড়তে পারেন।

৪. আবার যারা প্রণোদনার ঋণ সুবিধা পেয়েছিলেন, তারা যদি এখন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে না পারেন, তাহলে ঋণের টাকা ফেরত দেবেন কীভাবে, সেটিও চিন্তার ব্যাপার।

৫. দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, দোকানপাট মার্কেটের ফরমায়েশ খাটা কর্মী, দারোয়ান, কুলি, মুচি, ঝালমুড়ি বিক্রেতা এই সাধারণ মানুষগুলো কতদিন এভাবে চলতে পারবেন?

৬. অন্যদিকে বাস্তবতা হলো লকডাউন দিয়ে করোনাকে কিছুটা দমানো গেলেও এটা স্পষ্ট যে করোনার সঙ্গে আরও হয়তো অনেক মাস কিংবা বছর আমাদের বসবাস করতে হবে। এখন পর্যন্ত মাত্র ৩% জনগণকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা গেছে। যতদিন না  প্রাপ্তবয়স্কদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যায়, ততদিন পর্যন্ত করোনা মোকাবিলায় পন্থাগুলো ভাবতে হবে। আবার ভ্যাকসিন সবাইকে দেওয়া গেলেও তা সবার জন্য পুরোপুরি কার্যকর নাও হতে পারে।

৭. সেক্ষেত্রে আমাদের অন্তত এক বছরের একটা সার্বিক করোনা মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে এভাবে দিনের পর দিন লকডাউন থাকলে তার অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করা অনেক মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। আমাদের বুঝতে হবে লকডাউনের পরেই করোনা বিদায় নিচ্ছে না।

৮. করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ব্যাপক ও কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি পালন করাই হচ্ছে উপায়। ঘরের বাইরে অফিস-আদালতে এবং পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরা কঠোরভাবে পালন করতে হবে।

৯. অতিদরিদ্র মানুষের খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য গত বছরের মতো ব্যবস্থা নিতে হবে, খাদ্য বিতরণের আওতা বাড়াতে হবে। এই হতদরিদ্র মানুষের কাছে করোনায় আক্রান্ত হয়ে জীবনের ঝুঁকির চেয়েও খাদ্য কষ্টের চিন্তা অনেক বেশি প্রকট।

১০. যেসব খাতকে লকডাউনের আওতার মধ্যে রাখা হয়েছে অর্থাৎ যারা তাদের ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারছেন না তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। এদের মধ্যে যারা ইতোমধ্যে ঋণ নিয়েছেন তাদের ফেরত দেওয়ার সময় বাড়িয়ে দিতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ সুবিধা দিতে হবে।

আরও পড়ুন : বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার গল্প

১১. যে সব খাত লকডাউনের আওতার বাইরে আছে অর্থাৎ যারা তাদের উৎপাদন কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন, তাদের আর নতুন প্রণোদনা দেওয়া যাবে না, কিংবা তাদের ইতোমধ্যে গৃহীত ঋণের অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

১২. স্বাভাবিক অর্থনৈতিক অবস্থাতে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের উন্নয়নের উজ্জ্বল চিত্রের পাশাপাশি দুর্বল দিক হচ্ছে আয় বৈষম্য। সেই আয় বৈষম্য আরও বাড়বে যদি আমরা বড় বড় উদ্যোগগুলোকে শুধু লকডাউনের আওতায় বাইরে রাখি, আর ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো হিমশিম খেতে থাকে বেঁচে থাকার জন্য। তাই আগামীর প্রণোদনা হতে হবে শুধু এ অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য।

১৩. স্বাস্থ্যবিধি মানা কঠোরভাবে আরোপ করতে দরিদ্র মানুষের মধ্যে মাস্ক ও সাবান বিতরণ করতে হবে, স্বাস্থ্যবিধির মানার গুরুত্বের বিষয়ে ব্যাপকভাবে প্রচার প্রচারণা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে। স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকতে হবে। আগামী অন্তত এক বছর কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে শিথিলতা আনা যাবে না। এটি পালন করতে পারলে সহসাই আবার লকডাউন দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।

১৪. এদেশে অনেক সচ্ছল মানুষ আছেন যারা মাসের-পর-মাস ঘরে থাকতে পারবেন, কোনো কাজ না করলেও জীবনযাপনের স্বাভাবিক গতি ধরে রাখতে সমস্যা হবে না। কিন্তু স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সরকারের পাশাপাশি সামর্থ্য অনুযায়ী বিত্তবানদের হতদরিদ্র মানুষকে সাহায্য করার উদ্যোগ নিতে হবে।

১৫. আর সবার প্রতি আহ্বান, যাদের সামর্থ্য আছে তারা যত বেশি পারেন দেশীয় পণ্য কিনুন। তাতে এদেশের অনেক কারিগর, ডিজাইনার, শ্রমিকসহ পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত নানামুখী মানুষের আয় বাঁচাতে, পেশা বাঁচাতে তা ভূমিকা রাখবে।

১৬. মানুষের জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টাকে আরও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় এগিয়ে নিতে হবে।

এসআর/এসকেডি