গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের কাতলামারী গ্রাম। জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে, গ্রাম রক্ষায় নির্মিত বেড়িবাঁধ ধরে যেতে হয় প্রত্যন্ত এ গ্রামে। বেড়িবাঁধের পাদদেশের কাতলামারী গ্রামে বসবাস করেন মিনা বেগম। বন্যাপ্রবণ এই এলাকায় যুগযুগ ধরে দারিদ্র্যপীড়িত হিসেবে কষ্টের জীবন তাদের। চার সন্তান নিয়ে মিনা বেগমের কষ্ট আরও বেড়ে যায় স্বামীর অকাল মৃত্যুতে। কষ্টের জীবন শেষ হওয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা বহুদিনের। কিন্তু মিলছিল না কোনো উপায়।

বিধবা মিনা বেগমের দুর্দশা ও ইচ্ছার খবর জানতে পারে এনআরবিসি ব্যাংক। সহায়-সম্বলহীন মিনা বেগমকে মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন পূরণে এনআরবিসি ব্যাংক তাকে দেয় ৫০ হাজার টাকার ব্যাংক ঋণ। সেই টাকা নিয়ে নিজের টিনের ঘরেই বসিয়েছেন হ্যাচারি। হাস-মুরগির ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করেন। তার অনুপ্রেরণায় বড় ছেলে আতিকুর রহমান মনির নবাবগঞ্জ বাজারে গড়ে তুলেছেন মুরগি বিক্রির দোকান। মিনা বেগমের স্বপ্ন বড় করে হ্যাচারি স্থাপন করা। তার হাত ধরেই কর্মের সুযোগ পাক প্রান্তিক এই গ্রামের অবহেলিত  নারীরা।

মিনা বেগমের মতো একই গ্রামের আরেক স্বপ্নবাজ নারী উদ্যোক্তা খালেদা বেগম। তিনিও ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খুলে এনআরবিসি ব্যাংকের ঋণ পেয়েছেন। বাড়ির আঙ্গিনায় গড়ে তুলেছেন বাহারী সবজির খামার। কৃষিকাজের পাশাপাশি পুঁজির যোগান পাওয়ায় শুরু করেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসা। স্বামী আজাদুল ইসলাম বাজারের সবজির দোকান পরিচালনা করছেন।

মিনা বেগম বলেন, স্বামী হারানোর পর অসহায় হয়ে পড়ি। নিজে সেলাই মেশিনের কাজ শিখেছিলাম কিন্তু মেশিন কেনার টাকা ছিল না। এনআরবিসি ব্যাংকের কাছ ঋণ সহায়তা পেয়ে একটি সেলাই মেশিন কিনি এবং ডিম ফোটানোর মেশিন কিনি। বড় ছেলেকে দোকান করে দিয়েছি বাজারে। তিন ছেলেকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে চাই। আমার স্বপ্ন বহুবছরের দারিদ্র্য যেন আমরা দূর করতে পারি।  

কাতলামারীর মিনা বেগম ও খালেদা বেগমের ব্যাংকের সহায়তায় উদ্যোক্তা হয়েছেন মুক্তা রানি, মণিকা রানি, মফিলা বেগম ও নূরজাহান বেগম। ফুলছড়ির আরেক গ্রাম  উড়িয়ার সুরমা আক্তার, শাপলা বেগম, নূরী চৌধুরী, হাসিনা খাতুন ও সুমি খাতুনও বিশেষ ঋণ সুবিধা পেয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার লড়াই করছেন।

এক সময়ের হতদরিদ্রদের এই সফলতার গল্প শুধু গাইবান্ধার গ্রামের নয়। সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম,  ময়মনসিংহ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের চর এবং হাওর অঞ্চলের অধিবাসীরা এভাবেই স্বপ্ন বুনছেন এনআরবিসি ব্যাংকের সহায়তায়। ব্যাংকটি তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চর ও হাওর অঞ্চলের মানুষদেরকে সঞ্চয়ী হওয়া এবং পুঁজি সংগ্রহ উদ্যোক্তা হয়ে গড়ে উঠতে উৎসাহিত ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছে।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকাণ্ডের আওতায় এনআরবিসি ব্যাংক দেশের প্রত্যন্ত হাওর ও চরাঞ্চলের হতদরিদ্রদের মানুষদেরকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসছে। মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ পাচ্ছেন এসব অঞ্চলের হতদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা। বিনা খরচে এসব অ্যাকাউন্টে অর্থ সঞ্চয় ও ঋণ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১ হাজার ৩০০ মানুষ এনআরবিসি ব্যাংকে ৩৯ লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন এবং ১০৫ জন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সাড়ে ৫২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন।

গ্রামের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এনআরবিসি ব্যাংকের নিয়মিত বড় কর্মসূচি ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় বিনা জামানতে ৫০ হাজার থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। স্বল্প সুদের এই ঋণ ইতোমধ্যে উদ্যোক্তা হয়েছেন প্রায় ৮৮ হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকা। সারাদেশের সাড়ে ৯ শাখা-উপশাখার মাধ্যমে এই ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।

সম্প্রতি সুবিধাভোগী নারী উদ্যোক্তা সম্মান জানাতে আয়োজন করা হয় উদ্যোক্তা সম্মেলনের। সেখানে অংশ নেওয়া ১০০ নারী তাদের অভিজ্ঞতা, সফলতা ও প্রতিবন্ধকতার গল্প শোনান। ওই অনুষ্ঠানের ফাঁকে কথা হয় এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএম পারভেজ তমালের সঙ্গে। তিনি বলেন, এনআরবিসি ব্যাংকের উদ্যোক্তারা সবাই প্রবাসী। প্রবাসীদের একটি স্বপ্ন থাকে দেশ নিয়ে ও দেশের মানুষের ভালো থাকা নিয়ে। সেই ভালো থাকার স্বপ্ন পূরণে আমরা এসেছি প্রত্যন্ত গ্রামে ব্যাংকিং সেবা নিয়ে। এখনো উল্লেখ করা মতো অর্জন আসেনি। তবে এসব সাহসী নারীদের গল্প আমাদের প্রেরণা যোগায়। এনআরবিসি ব্যাংক দারিদ্রমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ আরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাবে। গ্রামের মানুষের সততা, সাহস ও সফলতা হবে এনআরবিসি ব্যাংকে পথচলার সঙ্গী।  

সম্মেলনের ফাঁকে নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলেন কুড়িগ্রামের জহুরা বেগম, সিরাজগঞ্জের নাজেরা বেগম, গাইবান্ধার মনোয়ারা বেগমসহ আরও কয়েকজন নারী উদ্যোক্তা। প্রত্যেকেই তাদের সফলতার গল্প শোনান। তারা জানান, তাদের হাতের কাছে কোনো ব্যাংক নেই। সেলাই মেশিন, পশুপালনে তাদের প্রশিক্ষণ থাকলেও ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। থানা ও জেলা সদরের কয়েকটি ব্যাংকে তারা চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু শর্তের কারণে ঋণ দেয়নি কোন ব্যাংক। এনআরবিসি ব্যাংক তাদেরকে ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দিয়েছে। পরে পেয়েছেন ৫০ হাজার টাকা ঋণ। ওই টাকা নিয়ে জহুরা বেগম হয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নাজিরা বেগম বীজ ব্যবসায়ী এবং  মনোয়ারা বেগম হয়েছেন খামারি। এখন তাদের স্বপ্ন সন্তানদেরকে উচ্চ শিক্ষিত করে তোলা এবং নিজেদের উদ্যোগ আরও বড় করা। কথার ফাঁকে এনআরবিসি ব্যাংকে তারা বটগাছের ছায়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর মন্নেয়ার পাড় গ্রামের মোছা. লাইজু খাতুন বলেন, ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খোলা যায় এটি জানতে পেরে এনআরবিসি ব্যাংকে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলি। আমার স্বামী দিনমজুর ছিলেন। সবসময় কাজ থাকতো না। আমারও কাজ করার সুযোগ ছিল না। কিছু একটার করার তাগিদে এনআরবিসি ব্যাংক যায় এবং তাদের সহযোগিতা ও পরামর্শে ৫০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করি। সেই টাকা একটি অটোরিকশা কিনে স্বামী চালানো শুরু করে। এখন প্রতিদিন আমাদের আয় ৫০০-৬০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে সহজেই আমরা নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাতে পারছি।

এসআই/জেডএস