রাজধানীর উত্তরা এলাকায় পোশাক শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন আহমেদ হোসেন। থাকেন আশকোনা এলাকায়। ‘লকডাউনে’ পরিবহন না থাকায় কিছু পথ হেঁটে আর কিছু পথ রিকশায় যেতে হচ্ছে তাকে। অনেক শ্রমিক একসঙ্গে কাজ করেন, তাই রয়েছে করোনার ঝুঁকিও। তারপরও যেতে হচ্ছে কাজে। কারণ কাজ না করলে মজুরি দেবে কে? এছাড়া সামনে ঈদ; সব কিছু বিবেচনায় স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েও কাজ করছেন।

আহমেদের মতো লাখ লাখ পোশাক শ্রমিক যানবাহন সংকটের মধ্যেই করোনার ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, অর্থনীতিকে সচল রাখছেন। কিন্তু বিনিময়ে বাড়তি কিছুই পাচ্ছেন না তারা। অথচ মহামারির ক্ষতি পূরণে নানা ছাড়, প্রণোদনা ও ঋণ সহায়তা নিচ্ছেন মালিকরা।

পোশাক শ্রমিক আহমেদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে বাসে যাওয়া-আসা করতে ২০ টাকা লাগত। এখন বাস বন্ধ। কিছু পথ হেঁটে তারপর রিকশায় করে গার্মেন্টসে যাই। প্রতিদিন ১০০ টাকার বেশি রিকশা ভাড়া লাগে। তবে সঙ্গে আরেকজন যাওয়ায় ৫০ টাকার মতো খরচ হয়। এই বাড়তি খরচ দেবে কে? সরকার বলছে পরিবহনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু আমরা কিছুই পাই নাই। তার ওপর প্রতিদিন ভয়ে থাকি কোন সময় করোনা ধরে। কিছু করার নাই ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হবে আমাদের। কাজ না করলে খাব কি? সংসার চলবে কেমনে? বেতন পাই সাড়ে ৯ হাজার টাকা। এ টাকায় ঘর ভাড়া, সংসারের খরচ কোনো মতে চলে। যখন বাড়তি খরচ হয়, তখনই সমস্যায় পড়ি। এখন বাড়তি ভাড়া লাগছে। এটাই সমস্যা।

আক্ষেপ প্রকাশ করে এ পোশাক শ্রমিক বলেন, করোনায় মালিক পক্ষ সরকারের কাছ থেকে কত সুবিধা নিচ্ছে। আর আমরা কী পাচ্ছি? গত বছর থেকেই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি। কোনো কিছুই তো পাই নাই। সুবিধা দিব কি, মাঝে মধ্যে বেতনই আটকে দেয়। নতুন করে সুবিধা চেয়ে আর চাকরি হারাতে চাই না। সামনে ঈদ সময় মতো বেতন বোনাস পেলেই আমরা খুশি।

গত বছরের ৮ মার্চ করোনায় প্রথম আক্রান্ত চিহ্নিত হওয়ার দুই সপ্তাহ পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের বেতন দিতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। তারও এক সপ্তাহ পর ৫ এপ্রিল ঘোষণা করা হয় বিভিন্ন খাতে ৬৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্যাকেজ। পরে বাড়িয়ে প্যাকেজ করা হয় ২১টি। মোট প্যাকেজের আকার দাঁড়ায় ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। যার বেশিরভাগই সুবিধা নেয় পোশাক কারখানার মালিকরা। এছাড়া ঋণ পরিশোধে ছাড়, রফতানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফএ’র আকার বাড়ানো, আমদানি-রফতানিতে বিভিন্ন নীতি সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু যে শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রমে অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে, তারা কিছুই পায়নি। উল্টো বিভিন্ন সময় পাওনা বেতন-মজুরির দাবিতে রাস্তায় নামতে হয়েছে তাদের।

করোনায় শ্রমিকরা কোনো সুবিধা পেয়েছে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করল শ্রমিকরা। আর সরকার প্রণোদনা দিল মালিকদের। তারপরও অনেক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। এখনও স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন না করেই কাজ করানো হচ্ছে। শ্রমিকরা শুধু চাকরি রক্ষা করতে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। কোনো ধরনের সুবিধা পাচ্ছে না।

তিনি জানান, আমরা গত বছর থেকে সরকারের কাছে শ্রমিকদের জন্য রেশনের ব্যবসা করার দাবি করে আসছি। পাশাপাশি মহামারির এ সময় কোনোভাবেই শ্রমিকদের ছাঁটাই করা যাবে না। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। আমরা এ বিষয়ে আবারও সরকারকে চিঠি দেব যেন শ্রমিকদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করা হয়। 

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, সব কিছু বন্ধ করে কারখানা খোলা রাখা হয়েছে। শ্রমিকদের যাতায়াতের জন্য কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। তারা দীর্ঘ পথ হেঁটে কারখানায় যাচ্ছেন। যা খুবই অমানবিক। এছাড়া অনেক শ্রমিক না খেয়ে আছেন। তাই খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য সরকার ও মালিকপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি। আমরা মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো উপায়ে শ্রমিকদের খাদ্য ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

কর্মস্থলে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন পোশাক শ্রমিকরা। তাই স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা, যাতায়াত ও ঝুঁকি ভাতা প্রদান এবং কর্মী ছাঁটাই বন্ধ করা দাবি জানিয়ে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, মালিকদের অনুরোধে শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই পোশাক কারখানা এই ‘লকডাউনের’ আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। কিন্তু কারখানার মালিকরা সরকারের বিধিনিষেধ মানছে না। শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। এসব বিষয় জানিয়ে আমরা ইতোমধ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। আমরা চাই শ্রমিকদের স্বার্থে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করবে সরকার।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক রফতানিকারক ও মালিক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রণোদনায় কিন্তু ফ্রি টাকা দেয়নি। ঋণ দেওয়া হয়েছে, যা আমাদের শোধ করতে হবে। বেতন-ভাতার জন্য যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, তা সরাসরি শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টে চলে গেছে। ওই সময় অনেক কারখানা বন্ধ ছিল, অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজ ছিল না কিন্তু শ্রমিকদের বেতন দিতে হয়েছে। ওই পরিস্থিতিতে আমরা লে-অফ করিনি, বেতন দিয়েছি। সরকার প্রণোদনা দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছে। অন্য যেসব প্রণোদনা দিয়েছে, তাও কিন্তু চলতি মূলধনের ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে।

শ্রমিকদের পক্ষে সব সময় বিজিএমইএ কাজ করছে জানিয়ে পোশাক মালিকদের এ নেতা জানান, আমরা শ্রমিকদের জন্য সরকারের কাছে রেশনের ব্যবস্থা দাবি করে আসছি। আসছে বাজেটে যেন এ ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয় সেজন্য সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় আমরা বলেছি। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

এসআই/এসএসএইচ