২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর। ঘড়িতে বিকেল সাড়ে চারটা। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে দুবাই থেকে ফিরলেন যাত্রী মোহাম্মদ আকবর হোসেন। বন্দরের গ্রিন চ্যানেল পেরোনোর সময় শুল্ক গোয়েন্দার একটি দলের মুখোমুখি তিনি। তথ্য ছিল, আকবর স্বর্ণ চোরাচালান দলের সদস্য। তল্লাশিতে নেওয়া হয় তার সঙ্গে থাকা ব্যাগসহ সব লাগেজ। কিন্তু ব্যাগ-লাগেজ থেকে কিছুই পাওয়া গেল না।

হঠাৎ গোয়েন্দাদের নজরে এল আকবরের হাতে ব্যাগের ডান পকেটে থাকা পণ্য একটি ক্রয়ের রশিদ। রশিদে আরবি ও ইংরেজিতে কিছু লেখা ছিল। লেখাগুলো পড়ে নিশ্চিত হওয়া গেল, এটি স্বর্ণ কেনার রশিদ। রশিদে রয়েছে দুবাইয়ের এসিএম গোল্ড জুয়েলারি থেকে এক হাজার ৭০০ দিরহামে ১০০টি স্বর্ণবার কেনার তথ্য। কেনা স্বর্ণের মোট ওজন ছিল ১১ কেজি ৬৬৪ গ্রাম। এত স্বর্ণ কার জন্য- আকবরের কাছ জানতে চাইলে মুহূর্তেই মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বুঝতে আর বাকি রইল না যে, তিনি চোরাচালান দলের সদস্য। স্বর্ণ কেনার প্রমাণ তো পাওয়া গেল। তাহলে স্বর্ণ কোথায়?

জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে আকবর স্বীকার করতে বাধ্য হন, নামার আগে স্বর্ণবারের ব্যাগটি ফ্লাইটের ভেতরে ডি/৮ নম্বর আসনের নিচে রেখে এসেছেন। সবুজ নামে তার এক বন্ধু ব্যাগটি সেখান থেকে নিয়ে যাবেন। শুল্ক গোয়েন্দা দল ছুটল স্বর্ণের ব্যাগ উদ্ধারে। তবে বন্ধু সবুজ ততক্ষণে খয়েরি রঙের ব্যাগ নিয়ে লাপাত্তা। সবুজকে আর পাওয়া গেল না।

এরপরই শুরু হলো স্বর্ণ চোরাচালানের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দফায় দফায় তদন্ত। দীর্ঘ প্রায় ৮ বছরের তদন্তে রহস্যের জট কিছুটা খুলতে সম্ভব হলেও স্বর্ণ চোরাচালানের পুরো নেটওয়ার্ক অধরাই থেকে গেল। 

ইমরান আহমেদ মির্জা ওরফে সবুজ এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন। আকবর ও সবুজের পাসপোর্টের তথ্য-উপাত্ত বলছে, মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে দুবাই থেকে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে তারা অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ বার আসা-যাওয়া করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এ সময়ে দুজনের পার্টনারশিপে ১৫০ থেকে ২০০ কেজি স্বর্ণ পাচার হয়েছে। যোগসূত্র একটিই- তাদের দুজনের বাড়িই চট্টগ্রামে।

পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র অনুসারে, মোহাম্মদ আকবর হোসেনের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানের কচুখাইন থানায়। কাগজপত্রে পেশা ব্যবসা লেখা থাকলেও আসলে তিনি চোরাচালান চক্রের সদস্য। অন্যদিকে ইমরান আহমেদ মির্জা ওরফে সবুজের বাড়িও চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে।

শুল্ক গোয়েন্দার তদন্তে দেখা যায়, পাসপোর্টের তথ্যানুসারে আকবর ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর দুবাই গিয়ে মাত্র চারদিন পর ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ঠিক একদিন পরই আবার ৭ ডিসেম্বর দুবাই গিয়ে পরদিন ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এর আগে আকবর ২০১৩ সালের ১৮ অক্টোবর দুবাই গিয়ে ১০ দিন পর ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশে ফেরেন। এভাবে ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দুবাই-বাংলাদেশে ১০ থেকে ১২ বার আসা-যাওয়ার তথ্য মিলেছে তদন্তে।

আকবরের নিয়োগকর্তা বা মূলহোতা হিসেবে চিহ্নিত ইমরান আহমেদ মির্জা ওরফে সবুজ। পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তার (সবুজ) দুটি পাসপোর্টের সন্ধান মিলেছে। একটি পাসপোর্ট (AGO018487) দিয়ে ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর ব্যাংকক হয়ে ঢাকা এয়ারপোর্টে আসেন এবং ১৪ ডিসেম্বর অন্য পাসপোর্ট (w0504736) দেখিয়ে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট হয়ে শারজাহ চলে যান। অর্থাৎ আকবর ধরা পড়ার ঘটনার এক সপ্তাহ পর দুবাই চলে যান সবুজ। 

তদন্তে বেরিয়ে আসে যে, দুটি পাসপোর্ট ব্যবহার করে সবুজ মাত্র ৬ মাসের মধ্যে ১০ বার বিদেশ গেছেন ও ১১ বার দেশে এসেছেন। এছাড়া অর্থের উৎস, অস্বচ্ছ লেনদেন ও ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে সবুজের সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্যও মিলেছে। চট্টগ্রামে ব্র্যাক ব্যাংকের একটি শাখায় তার হিসাবে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা জমা পাওয়া যায়। তবে বাড়ির স্বজনরা তার বিষয়ে নতুন কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তারা জানেন সবুজ বড় ব্যবসায়ী, তাই তাকে দেশে-বিদেশে যাওয়া-আসা করতে হয়। 

বিষয়টি তদন্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, তদন্তে দেখা গেছে আসামিরা বাংলাদেশ থেকে বারবার অবৈধ পন্থায় টাকা পাচার করে বিদেশে থেকে স্বর্ণ কিনে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে একই দেশে বারবার যাওয়া-আসা এটিই প্রমাণ করে যে, আসামিরা অবৈধভাবে বিদেশে টাকা পাচার করে রূপান্তরিত পণ্য হিসেবে দেশে স্বর্ণ নিয়ে আসেন। তারা একটি চক্রের সদস্য। কৌশলে তারা আইন পরিপন্থী কাজ করতেন। যদিও স্বর্ণের চালান আটক করা সম্ভব হয়নি। 

জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য ও অন্যান্য উপাত্ত বলছে, আসামিরা অন্তত ১৫০ থেকে ২০০ কেজি স্বর্ণ পাচার করেছেন। তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেলেও এ মুহূর্তে সবগুলো স্বর্ণবার পাচারের দায়ে তাদের অভিযুক্ত করা যাচ্ছে না। আপাতত সবুজ ও আকবরের বিরুদ্ধে ১১ কেজি ৬৬৪ গ্রাম ওজনের ১০০টি স্বর্ণবার চোরাচালানের মাধ্যমে অপসারণ করার অভিযোগ আনা হয়েছে। মানিলন্ডারিং আইনে অভিযোগ আনার পাশাপাশি ব্যাগেজ বিধিমালা ২০১২ অনুযায়ী ৩০ লাখ টাকার শুল্ক-কর ফাঁকির অভিযোগ আনা যাবে চার্জশিটে বা অভিযোগপত্রে।

আকবর ও সবুজের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর শুল্ক গোয়েন্দার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহীনা নাজনীন বাদী হয়ে দ্য কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯ ও মানি লন্ডারিং আইন ২০১২ অনুযায়ী বিমানবন্দর (ডিএমপি) থানায় মামলা দায়ের করেন।

দায়েরের পরপরই মামলাটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) স্থানান্তর করা হয়। বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে দুদক উপ-পরিচালক শাহীন আরা মমতাজ, উপ-পরিচালক মেফতাহুল জান্নাত ও উপ-সহকারী পরিচালক রাফি নাজমুস সাদাত মামলার তদন্তের দায়িত্বভার পালন করেন। তারা বিভিন্ন রেকর্ডপত্র সংগ্রহের এক পর্যায়ে দেখতে পান যে, মামলায় থাকা অভিযোগ চোরাচালান ও শুল্ক সংক্রান্ত অপরাধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। 
 
দুদকের সুপারিশে মামলার দায়িত্ব দেওয়া হয় এনবিআরকে। এরপর রাজস্ব কর্মকর্তা ইয়াকুত জাহিদকে ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা বিটন চাকমার ওপর তদন্তভার বর্তায়। তদন্তকালে গোয়েন্দারা মোহাম্মদ আকবর হোসেন ও ইমরান আহমেদ মির্জা ওরফে সবুজের সঠিক ঠিকানা এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্ক বের করতে সক্ষম হন। জিজ্ঞাসাবাদে আকবর হোসেন জানান সবুজ তার পূর্ব পরিচিত।

স্বর্ণ চোরাচালানের এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা ইয়াকুত জাহিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের আসল লক্ষ্য ছিল সবুজকে গ্রেফতার করা। কারণ প্রকৃত অপরাধী তিনি। আকবরকে রুটের সদস্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সবুজকে গ্রেফতার করতে পারলে পুরো চক্রটি বের করা যেত। কিন্তু সবুজ দুবাই পালিয়ে যাওয়ার পর আর দেশে ফেরেননি। তদন্তের এক পর্যায়ে আমারও বদলি হয়ে যায়। আমিও চলে আসি। সর্বশেষ অবস্থা জানি না। 

বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা বিটন চাকমার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, তদন্তের একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলাম। এরপর ঊর্ধ্বতনদের পক্ষ থেকে কিছু কোয়েরি (জিজ্ঞাসা) আসে, বর্তমানে কাজ চলছে।

তদন্তসূত্রে আরও জানা গেছে, ইমরান আহমেদ মির্জা ওরফে সবুজের আটটি ফোন নম্বরের কললিস্ট ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের আজাদী বাজার শাখায় ইমরানের নামের হিসাব পর্যালোচনা করে অর্থের উৎস, অস্বচ্ছ ও সন্দেহজনক লেনদেনসহ নানা অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে সবুজ অধরাই থেকে গেলেন। অন্যদিকে দীর্ঘদিন জেল খাটার এক পর্যায়ে আদালতের মাধ্যমে জামিন নিয়ে চট্টগ্রামেই আছেন অপর আসামি আকবর। 

আরএম/আরএইচ/ওএফ