দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত করে ২০০৪ সালে বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) যাত্রা শুরু হয়। এরপর সাবেক সেনাপ্রধান হাসান মশহুদ চৌধুরী, সাবেক সচিব গোলাম রহমান, মো. বদিউজ্জামান, ইকবাল মাহমুদ ও মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর মেয়াদের অবসান হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও দুদকের ভাবমূর্তির আশানুরূপ কোনো পরিবর্তন হয়নি।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করে। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিদ্যমান সংকট উত্তরণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব এই কমিশনের ওপর ন্যস্ত হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, অনুসন্ধান ও তদন্তে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করছে তারা। ইতোমধ্যে এ কমিশনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু বড় ধরনের সাফল্য পরিলক্ষিত হয়েছে।

সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুদকে ১২ হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৬৩টি অভিযোগের বিষয়ে প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি মামলা ও চার্জশিটে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ‘ভিআইপি’ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দুদকের জালে আটকা পড়েছেন।

অভিযুক্তদের তালিকায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবার, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় সব মন্ত্রী, সাবেক আমলা এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠীর মালিকরা রয়েছেন। ইতোমধ্যে দুর্নীতিবাজদের দেশে-বিদেশের প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা হয়েছে। অর্থাৎ, অসীম ক্ষমতার দুর্গে হানা দিয়ে বিদায়ী বছরে রেকর্ড সাফল্য দেখিয়েছে দুদক।

তবে, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া কিংবা দুদক সংস্কারে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ার বিতর্ক থেকে সংস্থাটি এখনো মুক্ত হতে পারেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান নেওয়া ছাড়া রাষ্ট্রের জন্য অন্য কোনো বিকল্প নেই। দুর্নীতি দমন কমিশন সেই রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে গত এক বছরে তার কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীবিশেষকে লক্ষ্য করে নয়; বরং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুরক্ষাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। সে কারণেই অনুসন্ধান, মামলা ও সম্পদ অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার ক্ষেত্রে অতীতের তুলনায় দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে।”

স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও আইনগত টেকসইতার পরীক্ষায় প্রতিটি পদক্ষেপকে উত্তীর্ণ করতে দুদক বদ্ধপরিকর বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

দুদকের জালে সাড়ে ৩ হাজার ভিআইপি

দুদকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৮৯০টি মামলা ও চার্জশিটে বিভিন্ন শ্রেণীর সাড়ে তিন হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীসহ অধিকাংশ ভিআইপি পর্যায়ের ব্যক্তিরা দুদকের জালে ফেঁসেছেন। এর মধ্যে দুই হাজার ২৯৭ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৫৪১টি মামলা দায়ের করে দুদক। আর একই সময়ে এক হাজার ২০৩ জন আসামির বিরুদ্ধে ৩৪৯টি মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়।

এ ছাড়া, একই সময়ে আরও ১ হাজার ৬৩টি নতুন অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে ৩৮২টি সম্পদ বিবরণী নোটিশ। বিগত ১১ মাসে ২৩০ জন ব্যক্তিকে অব্যাহতি দিয়ে ৮২টি চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআর) এবং ৩৯টি পরিসমাপ্তির মাধ্যমে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

তুলনামূলক বিচারে ২০২৪ সালের প্রথম ১১ মাসে (জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) বিভিন্ন অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে মাত্র ৪৩৯টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হয়েছিল। ওই সময়ে দুদক ৩২৮টি মামলা করেছিল এবং ৩৪৫টি মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছিল। তবে ওই বছরের নভেম্বরে কোনো কমিশন না থাকায় নতুন কোনো অনুসন্ধান বা মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়া ওই বছর ২২৭টি অভিযোগ নথিভুক্তির (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয় এবং ৪৮টি মামলা থেকে আসামিদের অব্যাহতি বা পরিসমাপ্তি দেওয়া হয়।

তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ৮৪৫টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছিল। ওই সময়ে ৪০৪টি মামলা হয়েছিল এবং ৩৬৩টি মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়েছিল। তবে ওই বছর ১৩ হাজার ৫৭৯টি অভিযোগ নথিবদ্ধ বা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছিল। অর্থাৎ সেসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক অনুসন্ধান বিভাগ দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি।

তিন বছরের তুলনামূলক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরে মামলা-চার্জশিট কিংবা অনুসন্ধান প্রতিটি ক্ষেত্রে দুদক অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সাফল্য দেখিয়েছে।

বিদায়ী বছরে দুদকের সাড়ে তিন হাজার আসামির তালিকায় রয়েছেন— ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহেনা, ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোনের ছেলে রাদওয়া মুজিব, মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা।

এ ছাড়া, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, এস আলম গ্রুপের মালিক শামসুল আলম, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, হাসানুল হক ইনু, আনিসুল হক, দীপু মনি, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও নাজমুল হাসান পাপন, টিপু মুনশি, গোলাম দস্তগীর গাজী, জাহিদ মালিক, নসরুল হামিদ বিপু, খালিদ মাহমুদ চৌধুরীসহ আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের আসামি করা হয়েছে। তালিকায় রয়েছেন এস আলম গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, নূরজাহার গ্রুপ, অ্যাননটেক্স গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ও জেমকন গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও।

সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজে রেকর্ড

বিগত ১১ মাসে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার ক্ষেত্রে রেকর্ড সাফল্য দেখিয়েছে দুদক। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশে-বিদেশে দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারী, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎকারী এবং ঋণখেলাপিসহ প্রায় সাড়ে ৩০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ২৭ হাজার ৯৬০ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে।

সেখানে ২০২৪ সালের পুরো সময়ে ক্রোক ও অবরুদ্ধকৃত সম্পদের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৬১ কোটি টাকা। এমনকি ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিগত পাঁচ বছরে মোট ক্রোক ও অবরুদ্ধ সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় তিন হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ১১ মাসে সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার ক্ষেত্রে দুদক নতুন এক মাইলফলক স্পর্শ করেছে।

আদালত ও দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ১১ মাসে দেশে চার হাজার ২৯০ কোটি ৪০ লাখ ২১ হাজার ৬৯৪ টাকার স্থাবর সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দেশে ২২ হাজার ৬২২ কোটি ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৪৪৬ টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে।

অন্যদিকে বিদেশে স্থাবর সম্পদ হিসেবে ৯৬ কোটি ৫৩ লাখ ৮০ হাজার ২৫ টাকা এবং অস্থাবর হিসেবে ৯৪৪ কোটি ৫৮ লাখ ৩০ হাজার ৯১৬ টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে-বিদেশে ৩৩৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সম্পদ ক্রোক-ফ্রিজ করা হয়েছে।

অন্যদিকে ১১ মাসে বিচারাধীন মামলার মধ্যে ২৪৯টি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। যেখানে সাজা হয়েছে ১২৬টির, খালাস ১২৩টি, জরিমানা আদায় করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৮ কোটি টাকা, বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ৩২১ কোটি টাকা। ওই সময়ে ১১ হাজার ৬৩০টি অভিযোগ এলেও মাত্র ৯৬০টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় এনফোর্সমেন্ট হয়েছে ৭৯৮টি।

১১ বিশেষ টাস্কফোর্সে আলোচিত ব্যবসায়ী গ্রুপ

চলতি বছরে দুর্নীতি, অর্থপাচার, ব্যাংক ঋণ জালিয়াতি ও বড় শিল্পগোষ্ঠীর অনিয়ম খতিয়ে দেখতে ১১টি বিশেষ ‘টাস্কফোর্স’ বা যৌথ তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের শীর্ষ ১০টি শিল্পগোষ্ঠী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনিয়ম এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অর্থপাচার, ব্যাংক ঋণ দুর্নীতি, কর ফাঁকিসহ অন্যান্য অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

শিল্পগ্রুপের মধ্যে রয়েছে- এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি, এইচ এম ইকবাল সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও শেখ পরিবার।

দুদকের যৌথ তদন্ত দল ইতোমধ্যে ১০৪টি মামলা দায়ের করেছে। যার মধ্যে ১৪টি মামলায় চার্জশিট দাখিল এবং চারটি মামলায় আদালতের রায় প্রদান করা হয়েছে। অনুসন্ধান ও তদন্তকালে দেশে ৫৫ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা এবং বিদেশে ১০ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ ফ্রিজ ও সংযুক্ত (ক্রোক) করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে ও বিদেশে ৬৬ হাজার ১৪৬ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ ও সংযুক্ত করা হয়েছে।

এ ছাড়া, বিদেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে আইনি সহযোগিতা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে ২১টি মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে।

দুদকের কাঠগড়ায় শেখ পরিবার

চব্বিশের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার দায়ে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর পাশাপাশি পিছিয়ে নেই দুর্নীতি ও অনিয়ম সংক্রান্ত মামলার তদন্তও।

গত এক বছরে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ১৫টির বেশি মামলা হয়েছে। এরই মধ্যে রাজধানীর পূর্বাচলে ৬০ কাঠা প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় আদালত রায় ঘোষণা করেছেন। রায়ে শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, ভাগনি ও ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকসহ পরিবারের সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব সালাউদ্দিন এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১৪ কর্মকর্তার বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে।

এক বছরের ব্যবধানে শেখ পরিবারের সদস্য ও ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত উল্লেখযোগ্য মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে— সেতুর টোলের ৩০৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ, সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৬০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ, টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ঘুষ হিসেবে গুলশানের প্লট দুর্নীতির মামলা, সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে ৪৪৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ, সিআরআই-এর অনুদানের ৪৩৯ কোটি টাকা লেনদেনে অনিয়ম, রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের নামে অবৈধ সম্পদের মামলা এবং রাদওয়ানের চাচা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের পরিবারের বিরুদ্ধে ৬২ কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা।

অন্যদিকে গত এক বছর ধরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচারের অভিযোগ এবং শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরিবারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধানও চলমান রয়েছে। এছাড়া, প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে শেখ মুজিবের জন্মশত বার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ পালন এবং শেখ মুজিবের ১০ হাজারের বেশি ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণ করে অর্থ অপচয়, ক্ষতিসাধনের অভিযোগে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহেনাসহ অন্যান্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।

আলোচিত টিউলিপ সিদ্দিক

চলতি বছরে দেশের যে কয়টি মামলা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে, তার মধ্যে টিউলিপ সিদ্দিকের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও বিতর্কিত। ব্রিটিশ এমপি এবং বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ায় মামলাটি শুধু আইনি নয় বরং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মাত্রাও লাভ করেছে।

২০২৫ সালের শুরুতে তার বিরুদ্ধে রাজধানীর রাজউকে প্লট গ্রহণ ও সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত একাধিক অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধানে ক্ষমতার প্রভাব ও পারিবারিক পরিচয় ব্যবহার করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে প্লট ও সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছে সংস্থাটি।

ঢাকার গুলশানের একটি প্লট ‘অবৈধভাবে হস্তান্তরের ব্যবস্থা’ করে দেওয়ার বিনিময়ে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের কাছ থেকে ‘ঘুষ’ হিসেবে একটি ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগে টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়া, পূর্বাচলে মা শেখ রেহানা, ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও বোন আজমিনা সিদ্দিকসহ পরিবারের সদস্যদের নামে ৩০ কাঠা প্লট বরাদ্দ নেওয়ার মামলার রায়ে ইতোমধ্যে তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

দুদকের মামলার ভিত্তিতে আদালত টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছিলেন। সাধারণত দেশীয় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা নিয়মিত ঘটনা হলেও, একজন বিদেশি এমপি ও ব্রিটিশ সরকারের সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণার ঘটনা নজিরবিহীন বলে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও টিউলিপ সিদ্দিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দুদকের মামলা ও আদালতের এই রায়কে “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ত্রুটিপূর্ণ ও প্রহসনমূলক” বলে অভিহিত করে আসছেন।

আলোচিত দুদক কর্মকর্তা শরীফের চাকরি পুনর্বহাল

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বরখাস্ত হওয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আলোচিত উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে গত ৯ জুলাই চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে বকেয়া বেতন-ভাতাসহ সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাকে চাকরিতে যোগদানের সুযোগ দিতে বলা হয়েছিল।

পরবর্তী সময়ে দুদক এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে গত ৯ নভেম্বর চেম্বার আদালতের রায়ও শরীফ উদ্দিনের পক্ষে যায়। সর্বশেষ আদালতের রায়সহ গত ১২ নভেম্বর চাকরিতে যোগদানের অনুমতি চেয়ে দুদক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন তিনি। তবে, প্রশাসনিক ও আইনি জটিলতায় শরীফ উদ্দিন এখনো সংস্থায় কাজে ফিরতে পারেননি। দীর্ঘ তিন বছর পর চাকরি ফিরে পাওয়ার এই রায় চলতি বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা।

২০২২ সালের ১৩ মার্চ চাকরি ফেরত চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন মো. শরীফ উদ্দিন। তার পক্ষে ব্যারিস্টার মিয়া মোহাম্মদ ইশতিয়াক রিটটি দায়ের করেছিলেন। এর আগে ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সই করা এক প্রজ্ঞাপনে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তার অপসারণের পরপরই সারা দেশে দুদকের কর্মকর্তারা নজিরবিহীন আন্দোলনে নেমেছিলেন; যদিও সে সময় তার চাকরি রক্ষা হয়নি।

দুদক সংস্কার কমিশন

বিদায় নিতে যাওয়া ২০২৫ সালে আরও একটি আলোচিত ঘটনা হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে কমিশন গঠন। ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানকে প্রধান করে আট সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়।

দীর্ঘ যাচাই-বাচাই শেষে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দাখিল করার পর গত ৮ ফেব্রুয়ারি সরকার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার মধ্যে বিভিন্ন এজেন্সির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করা এবং ‘স্বাধীন’ ও ‘সাংবিধানিক’ স্বীকৃতি দেওয়াসহ সংস্থাটির সংস্কারে ৪৭টি সুপারিশ করা হয়েছিল। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে দুদককে একটি ‘কার্যকর’ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেব গড়ে তুলতে এবং প্রতিষ্ঠানটির আমূল সংস্কারে বিভিন্ন সুপারিশের পাশাপাশি ক্ষমতার অপব্যবহার, আইন পরিবর্তনসহ ১০টি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেছিল দুদক সংস্কার কমিশন।

তবে, গত ২৮ নভেম্বর ‘দুদক অধ্যাদেশ ২০২৫’ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুপারিশ বাদ দেওয়ায় গভীর ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির অভিযোগ, ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিতে প্রতিপক্ষকে লক্ষ্যবস্তু (টার্গেট) করার হাতিয়ার হিসেবে দুদককে ব্যবহার করার যে প্রবণতা, তা বন্ধের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত “বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি” ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জন্মলগ্ন থেকেই দুদক জনআস্থার সংকটে ভুগছে। ক্ষমতাসীনদের সুরক্ষা দেওয়া ও প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের যে ইতিহাস, তা থেকে বেরিয়ে আসতে ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ ছিল কৌশলগতভাবে অত্যন্ত জরুরি। সরকার তা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

আরএম/এমজে