আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) ও তার সহযোগীদের যোগসাজশে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্স থেকে লুটপাট হয় দুই হাজার কোটি টাকা। শুধুমাত্র একটি কম্পিউটার ব্যবহার করে ৩০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে মর্টগেজ ছাড়াই ঋণ নিয়ে ওই টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

আরবি এন্টারপ্রাইজ, জিঅ্যান্ডজি এন্টারপ্রাইজ, তামিম অ্যান্ড তালহা এন্টারপ্রাইজ, ক্রসরোড কর্পোরেশন, মেরিন ট্রাস্ট, নিউটেক, এমএসটি মেরিন, গ্রিন লাইন ডেভেলপমেন্ট, মেসার্স বর্ণসহ প্রায় ৩০টির মতো অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। যার রেকর্ডপত্র এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান টিমের কাছে। এ অনিয়মের সঙ্গে পিকে হালদার, ওইসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এমডিসহ প্রায় ৭৫ জনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। তাদের আসামি করে আরও ৩০টি মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন সূত্রে জানা গেছে। পিকে হালদার সিঙ্গাপুর, ভারত এবং কানাডায় চার শতাধিক কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধান টিমের তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদক পরিচালক বেনজীর আহমেদের কাছে জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমাদের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে। করোনা মহামারির কারণে অনুসন্ধান কাজের গতি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনুসন্ধান টিমের সুপারিশের আলোকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। মামলা হলে জনসংযোগ দফতরের মাধ্যমে তা জানতে পারবেন।

অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এর আগে পিকে হালদার ইস্যুতে আমাদের টিম ১৫টি মামলা করেছে। অনুসন্ধান পর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। এর বাইরে জানতে হলে ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্স প্রায় ৩০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মর্টগেজ ছাড়াই প্রায় ২০০০ কোটি টাকা জালিয়াতিপূর্ণ ঋণ প্রদানের রেকর্ডপত্র পাওয়া গেছে। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে ভিন্ন খাতে ওই অর্থ বের করে নেওয়া হয়। ওই ঋণ পরিশোধ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। পি কে হালদার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, এমডিসহ প্রায় ৭৫ জনকে আসামি করার মতো প্রমাণ পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, কাগুজে-ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে জালিয়াতি করে নেওয়া এসব ঋণের অর্থ নানা পর্যায় পেরিয়ে যোগ হতো পিকে হালদারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। এমনই এক অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান কনিকা এন্টারপ্রাইজ। গুলশান এভিনিউ নর্থ বাণিজ্যিক এলাকায় ঠিকানা ব্যবহার করা কনিকা এন্টারপ্রাইজের মালিক দেখানো হয়েছে রাম প্রসাদ রায়কে। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর আবেদনের  পরিপ্রেক্ষিতে নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করার জন্য ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে ৪৫ কোটি টাকার স্বল্পমেয়াদি ঋণ মঞ্জুর করা হয়। অথচ পিকে হালদারের মালিকানাধীন ২৫.৬০ কোটি টাকা মূল্যের ২০০ শতাংশ জমি বন্ধক হিসেবে দেখানো হয়। ঋণের বিপরীতে হিসাবটিতে কোনো আদায় বা বিক্রয় লব্ধ অর্থ জমা প্রদান করার নজির পায়নি দুদকে।

আরেকটি প্রতিষ্ঠান মুন এন্টারপ্রাইজ। ২০১৬ সালের ৬ মার্চ শংখ বেপারীর মালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২২ মার্চ এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ১৭৬তম পরিচালনা পর্ষদ সভায় ৩৫ কোটি টাকার স্বল্পমেয়াদি ঋণ মঞ্জুর হয়। এখানেও ঋণের বিপরীতে প্রশান্ত কুমার হালদারের মালিকানাধীন প্রায় ১৯.৩৪ কোটি টাকার মূল্যে ১৫০ শতাংশ জমি বন্ধক রাখা হয়। অবাক করার বিষয় এই প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ও কনিকা এন্টারপ্রাইজের ঠিকানা একই। এখানেও ঋণের বিপরীতে হিসাবটিতে কোনো আদায় বা বিক্রয় লব্ধ অর্থ জমা প্রদান করার নজির ছিল না।

মেসার্স বর্ণ : অনঙ্গ মোহন রায়ের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বর্ণ। পুরানা পল্টনের ঠিকানা ব্যবহার করা প্রতিষ্ঠানটির ধান, চাল, গম, ভুট্টা, মসুর ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি ও সরবরাহকারী ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর ঋণের জন্য আবেদন করে। এর পরপরই এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ১৬৩তম পরিচালনা পর্ষদ ছয় বছর মেয়াদি ৩৮ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়। ঋণের বিপরীতে প্রায় সাড়ে ৩৩ কোটি টাকার ২১.৯০ শতাংশ জমি জামানত রাখা হয়। অনঙ্গ মোহন রায় অরিয়েল লিমিটেডে ও বর্ণ দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। ঋণের ওই বাংলাদেশ ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে তা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়।

আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড : আলোচিত উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও অনিতা করের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। যদিও ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর তারা পদত্যাগ করলে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে অভিজিৎ অধিকারী তীর্থ ও এমডি হিসেবে পিকে হালদারের ভাই প্রিতীশ কুমার হালদার দায়িত্ব নেন। কেমিক্যাল সামগ্রী সরবরাহ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ঋণের আবেদনের বিপরীতে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের অনুকূলে ৪০ কোটি টাকার স্বলমেয়াদি ঋণ মঞ্জুর করা হয়। ঋণের বিপরীতে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের ১ কোটি ৪৪ লাখ ৪০ হাজার ৯০০টি শেয়ার জামানত রাখা হয়।

নিউটেক এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, দেয়া শিপিং লি. ও এমটিবি মেরিন লি. নামীয় নামসর্বস্ব ৪টি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়। এর মধ্যে নিউটেক এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড ও ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের রেজিস্টার্ড অফিস ও ব্যবসায়িক অফিস একই। প্রতিষ্ঠান দুটির রেজিস্টার্ড অফিসে কোনো অফিসিয়াল কার্যক্রম খুঁজে পাওয়া যায়নি ও বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠান ৪টির নামে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড হতে প্রায় ১৭৪ কোটি টাকার ঋণ প্রদান করা হয়েছে। ৪টি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বিতরণকৃত ঋণের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে অন্য গ্রাহকের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঋণসমূহের প্রকৃত সুবিধাভোগীকে আড়াল করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের চেকের অপব্যবহার হয়ে হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় অন্যান্য আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান থেকেও একই প্রক্রিয়ায় অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে।

পি কে হালদারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বিভিন্ন কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে অন্তত চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।

কোম্পানিগুলো হলো : ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। এসব কোম্পানি থেকে তিনি ঋণের নামে বিপুল অঙ্কের টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন।

শুধু জালিয়াতি বা অর্থ আত্মসাৎ করেই থেমে যাননি পিকে হালদার। আত্মসাৎকৃত অর্থে বিলাসী জীবন কাটিয়েছেন তিনি। জমি কিনেছেন। আবার সে অর্থের একটি অংশ পাচার করেছেন সিঙ্গাপুর, ভারত ও কানাডায়। এখন পর্যন্ত দুদকের অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে ৪০০ কোটির বেশি টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া কানাডায় পিকে হালদারের শপিং কমপ্লেক্স, বিলাসবহুল বাড়িরও তথ্য পেয়েছে দুদক। 

পি কে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা

ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে দুদক। গত ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করে ইন্টারপোল। দুদক উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে আরও একটি টিম তার আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়টি অনুসন্ধান করছে। ওই টিম এরই মধ্যে ১৫টি মামলা করেছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ভুয়া নামে ঋণ উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা এবং ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করে দুদক।

গ্রেফতার ও স্বীকারোক্তি

পি কে হালদার কেলেঙ্কারিতে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন ১১ জন। যাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ছাড়াও পি কে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারী, রাশেদুল হক এবং সর্বশেষ অবান্তিকা বড়াল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আরএম/এসকেডি