ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকার পর এবার পণ্য না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রিয়শপ ডট কমের (priyoshop.com) বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) দফতরে জমা পড়েছে অসংখ্য অভিযোগ। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম নিয়ে ছায়া তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

গ্রাহকদের অভিযোগ, টাকা ফেরত চাইলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা তাদের জানান, নগদ টাকা নেই, ব্যাংকেও টাকা জমা নেই। তাই টাকা ফেরত দিতে সময় লাগবে।

তবে প্রিয়শপের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রতিশ্রুত সময়ে পণ্য বা টাকা ফেরত না দেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। অর্ডার করে পণ্য না পেলে টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিফান্ড হয়ে যায়।

টাকা ফেরত চাইলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা তাদের জানান, নগদ টাকা নেই, ব্যাংকেও টাকা জমা নেই। তাই টাকা ফেরত দিতে সময় লাগবে

এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর জানায়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ জমা পড়ছে। প্রিয়শপের বিরুদ্ধেও বেশ কয়েকজন ভোক্তা অভিযোগ দিয়েছেন। অধিকাংশ অভিযোগই প্রতিশ্রুত সময়ে পণ্য না দেওয়া এবং পণ্যের জন্য অগ্রিম পরিশোধ করা টাকা ফেরত না দেওয়া। অধিদফতর সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভিযোগগুলো নিষ্পত্তির চেষ্টা করছে।

গত বৃহস্পতিবার ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী চেয়ারম্যান শামীমাকে গ্রেফতারের পর বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের হিড়িক পড়ে বিভিন্ন দফতরে।

ভোক্তা অধিকারে প্রিয়শপের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন শাহজাহান (ছদ্মনাম) নামের এক গ্রাহক। তিনি সেখানে উল্লেখ করেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি একটি মোবাইল ফোন অর্ডার দিই। মাসখানেকের মধ্যে পণ্য দেওয়ার কথা বললেও সাত মাসেও তা পাইনি। তারা দেব-দিচ্ছি বলে আমাকে ঘোরাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মাহবুব আলম আমাকে বেশ কয়েকবার পণ্য দেওয়ার আশ্বাস দিলেও তা দেননি। মূল টাকা ফেরত চাইলেও তারা ফেরত দেয়নি। বাধ্য হয়ে আর্থিক ক্ষতিপূরণের আশায় মামলাটি করেছি।

সাঈদুর রহমান নামের আরেক গ্রাহক (ছদ্মনাম) অভিযোগ করেন, চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল প্রিয়শপ থেকে অগ্রিম টাকা পরিশোধের মাধ্যমে কিছু পণ্য অর্ডার করি। এগুলো সাত থেকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে দেওয়ার কথা। তবে চার মাস পর আগস্টেও পণ্য না পেয়ে প্রিয়শপের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা সমাধান দিতে না পারায় পণ্য কেনার প্রমাণপত্রসহ ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট দিই। পোস্ট দেখে তাদের কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স বিভাগের মাহবুব আমাকে তা ডিলিট করতে বলেন। টাকা ফেরত না দেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জানান, তাদের ক্যাশ ফ্লো জিরো (নগদ টাকা নেই), ব্যাংকেও টাকা নেই। এখন আমি আমার টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত।

রুনা আক্তার নামের এক ভুক্তভোগী জানান, প্রিয়শপ থেকে তিনি ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর একটি ভাউচার কেনেন, যা এক মাস পর অ্যাক্টিভ হওয়ার কথা ছিল। তবে এক মাস পরও প্রতিষ্ঠানটি তার কার্ড চালু করেনি। বিষয়টি নিয়ে তিনি কমপক্ষে ৫০-৬০ বার ফোন করেন। অবশেষে জুলাই মাসে তার কার্ড চালু করা হয়। সেই কার্ডের সঙ্গে তিনি আরও এক হাজার ৩০০ টাকা দিয়ে কয়েকটি পণ্য অর্ডার করেন। প্রতিষ্ঠানটি তাকে ৬০০ টাকার পণ্য দেয়। বাকি পণ্য দেয়নি। বারবার কল করলেও প্রিয়শপ বলেছে, লকডাউনের পর দেবে। কিন্তু এখনও দেয়নি।

এদিকে, ভোক্তাদের পণ্য কিংবা টাকা ফেরত না দিতে পারলেও অফারের পর অফার দিয়ে যাচ্ছে প্রিয়শপ। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখে ইয়ামাহা আর-ওয়ান ফাইভ-ভি-থ্রি মডেলের ইন্দোনেশিয়ান একটি বাইক চার লাখ ৪৬ হাজার ২৫০ টাকায় বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়। যদিও বাইকটির বাজারমূল্য পাঁচ লাখ ২৫ হাজার টাকা। বিজ্ঞাপনে তারা ১০ দিনে ডেলিভারির নিশ্চয়তা দিলেও আদৌ তা সম্ভব কি না, তা নিয়ে গ্রাহকদের সংশয় রয়েছে।

প্রিয়শপের বিরুদ্ধে ছায়া তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি

গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে ইতোমধ্যে প্রিয়শপের বিরুদ্ধে ছায়া তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক লেনদেন, ডেলিভারি প্রক্রিয়া ও টাকা পাচারের কোনো তথ্য পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেবে সংস্থাটি।

এ বিষয়ে সিআইডির অরগানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা কিছু ই-কমার্স সাইটের বিষয়ে ছায়া তদন্ত করছি। এছাড়া গ্রাহকরা আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ নিয়ে আসছেন, সেগুলো নিয়েও তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষ হলে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।’

অভিযোগের বিষয়ে যা বলছে প্রিয়শপ

প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে পণ্য বা টাকা ফেরত না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিয়শপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আশিকুল আলম খাঁন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নয় থেকে ১০ মাসে পণ্য না পাওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। আপনি অফিসে আসেন। আমাদের ডেলিভারির প্রক্রিয়াটি দেখলেই সব স্পষ্ট হয়ে যাবেন। গ্রাহকদের যে কোনো অভিযোগে আমরা নিয়মিত রেসপন্স করি। আমাদের এখানে যারা অর্ডার প্লেস করেন, তারা যদি পণ্য না পান, তাহলে অর্থ অটোমেটিক রিফান্ড হয়ে যায়। গোটা প্রক্রিয়াটি অটোমেটিক, মাসের পর মাস আটকে থাকার সুযোগ নেই।’

এদিকে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিভাবক সংগঠন ই-ক্যাবের কাছেও প্রিয়শপের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে চিঠিও দিয়েছে ই-ক্যাব।

ই-ক্যাব যা বলছে

ই-ক্যাবের জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযুক্ত ১৬টি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় প্রিয়শপের নাম ছিল। ই-ক্যাব ও ভোক্তা অধিকারে আসা অভিযোগ সমাধানের জন্য তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ নিষ্পত্তির পর তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। ডিজিটাল কমার্স নির্দেশিকার নিয়ম হালনাগাদ হয়েছে। নতুন অভিযোগ এলে তা ই-ক্যাব থেকে অবশ্যই দেখা হবে।

এআর/একে/আরএইচ/এমএআর