২০ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের ২৭২৮ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেও স্বস্তিতে নেই সোনালী ব্যাংক / প্রতীকী ছবি

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে হল-মার্কের ঋণ কেলেঙ্কারি। নজিরবিহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ভুঁইফোড় গ্রুপটিকে দেওয়া ব্যাংকটির প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। মামলা করেও ঋণ ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ঋণ কেলেঙ্কারির এ বোঝা কাগজে–কলমে কিছুটা কমাতে এক হাজার ২২৯ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ করেছে ব্যাংকটি। এতেও স্বস্তি মিলছে না। কারণ, এক টাকাও আদায় হচ্ছে না।

শুধু হল-মার্ক নয়, সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ প্রতিষ্ঠানের অবলোপন করা ঋণের ১৮টির আদায় ‘শূন্য’। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছয় হাজার ৯৯৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে সোনালী ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের ৩৮ শতাংশই পড়ে আছে ২০ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের কাছে।

দীর্ঘদিন পড়ে থাকা খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ায় হল-মার্কসহ শীর্ষ ২০ প্রতিষ্ঠানের দুই হাজার ৭২৮ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে সোনালী ব্যাংক। চলতি বছরে অবলোপন করা এ ঋণের ১০ শতাংশ অর্থাৎ ২৭২ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করে ব্যাংকটি। কিন্তু সর্বশেষ তথ্য বলছে, বছরের আট মাস পার হলেও লক্ষ্যের ৮ শতাংশও আদায় করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি

সোনালী ব্যাংকের বিশেষ এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘদিন পড়ে থাকা খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ায় হল-মার্কসহ শীর্ষ ২০ প্রতিষ্ঠানের দুই হাজার ৭২৮ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে সোনালী ব্যাংক। চলতি বছরে অবলোপন করা এ ঋণের ১০ শতাংশ অর্থাৎ ২৭২ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করে ব্যাংকটি। কিন্তু সর্বশেষ তথ্য বলছে, বছরের আট মাস পার হলেও লক্ষ্যের ৮ শতাংশও আদায় করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

আলোচিত হল-মার্ক গ্রুপের ১২২৯ কোটি ১৪ লাখ টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে সোনালী ব্যাংক / প্রতীকী ছবি

সোনালী ব্যাংকের ঋণ অবলোপনের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে আলোচিত হল-মার্ক গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির এক হাজার ২২৯ কোটি ১৪ লাখ টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে ব্যাংকটি। যার এক টাকাও আদায় হয়নি। এরপর রয়েছে মেসার্স নিউ রাখী টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড। তাদের ১২৩ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। মেসার্স জাসমির ভেজিটেবল অয়েলের অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। মেসার্স ফেয়ার এক্সপোর ৯৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা, মেসার্স আলফা টোবাকোর ৯৬ কোটি তিন লাখ টাকা, মেসার্স ওয়ান স্পিনিং মিলসের ৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা, মেসার্স ইম্পেরিয়াল ডায়িং অ্যান্ড হোসিয়ারির ৯০ কোটি ১৩ লাখ টাকা, মেসার্স রোকেয়া টেক্সটাইল মিলসের ৮২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, মেসার্স সাহিল ফ্যাশনের ৮১ কোটি ১৮ লাখ টাকা, মেসার্স ইমাম ট্রেডার্সের অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ৮০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, মেসার্স সুমি’স সোয়েটারের ৭৬ কোটি সাত লাখ টাকা, মেসার্স রিভারসাইড লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যারের ৭৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, মেসার্স ইউনিটি নিটওয়্যারের ৭১ কোটি ১৩ লাখ টাকা, মেসার্স সিদ্দিক ট্রেডার্সের ৬৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা, মেসার্স কেপিএফ টেক্সটাইলের ৬৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, মেসার্স মুন নিটওয়্যারের ৬৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, মেসার্স এ আর খান সাইজিং অ্যান্ড ফেব্রিকসের অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ৬৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, মেসার্স সাহিল নিটওয়্যারের ৫৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, যাদু স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ৫০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং মাস্ক সোয়েটারের ৪৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে সোনালী ব্যাংক।

ঋণ অবলোপন করা শীর্ষ ২০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মেসার্স ইম্পেরিয়াল ডাইয়িং অ্যান্ড হোসিয়ারি থেকে ৭১ লাখ টাকা এবং রিভারসাইড লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যারের কাছ থেকে ১৮ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। অর্থাৎ আট মাসে লক্ষ্যের ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ পূরণ করেছে সরকারের এ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাকি ১৮ প্রতিষ্ঠান থেকে এক টাকাও আদায় করা যায়নি

ঋণ অবলোপন করা শীর্ষ ২০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মেসার্স ইম্পেরিয়াল ডাইয়িং অ্যান্ড হোসিয়ারি থেকে ৭১ লাখ টাকা এবং রিভারসাইড লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যারের কাছ থেকে ১৮ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। অর্থাৎ আট মাসে লক্ষ্যের ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ পূরণ করেছে সরকারের এ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাকি ১৮ প্রতিষ্ঠান থেকে এক টাকাও আদায় করতে পারেনি সোনালী ব্যাংক।

তবে ব্যাংকাররা বলছেন, দীর্ঘদিন পড়ে থাকা বড় বড় খেলাপি ঋণ মামলা করেও আদায় হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে অবলোপন করতে হয়েছে। মামলা চলছে, খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ আছে। অর্থ আদায় হবেই।

রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় / ফাইল ছবি

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আতাউর রহমান প্রধান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নিয়ম মেনেই ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এসব ঋণের অর্থ আদায়ে মামলা চলমান। পাশাপাশি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়ও অর্থ আদায়ের চেষ্টা চলছে।’ এর বাইরে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

ঋণ অবলোপন বেশি হওয়া মানেই খেলাপিদের উৎসাহিত করা— এমন মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘ঋণ অবলোপন মানে ব্যাংক তার হিসাবে খেলাপিকে মন্দ ঋণ হিসাবে আর দেখায় না। তাদের আর্থিক প্রতিবেদন কাগজে-কলমে দেখতে ভালো লাগে। তবে এ প্র্যাকটিস কোনোভাবেই উৎসাহিত করা ঠিক নয়। ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর চেষ্টা চালাতে হবে।’

রাইট অফ কী

‘রাইট অফ’ মানে হলো মন্দ ঋণগুলোকে মূল ব্যাল্যান্স শিট থেকে সরিয়ে আলাদা একটি লেজারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। ঋণ অবলোপনের মূল দুটো শর্ত হলো- ১. ওই ঋণ সুদাসলে আদায়ের জন্য মামলা দায়ের করা, ২. যে পরিমাণ ঋণ ‘রাইট অফ’ করা হয়, তার সমপরিমাণ অর্থ ‘প্রভিশনিং’ বা ‘সঞ্চিতি’ করতে হয়। প্রভিশনিং মানে হলো ওই পরিমাণ অর্থ অন্য কাউকে ঋণ দেওয়া যাবে না।

২০০২ সালে চালু হয় রাইট অফ সিস্টেম। ২০১৯ সালের এপ্রিলে এসে এর বেশকিছু নীতিমালা শিথিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন নিয়মে তিন বছরের মন্দ ও ক্ষতিমানে শ্রেণিকৃত ঋণ অবলোপনের সুযোগ দেওয়া হয়। আগে যা ছিল পাঁচ বছর। এছাড়া দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ মামলা অবলোপনের সুযোগ দিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।

রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যালয় / ফাইল ছবি 

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করায় খেলাপিরা উৎসাহিত হচ্ছেন। তাদের ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা আরও বেড়েছে। অন্যদিকে, ব্যাল্যান্স শিট ভালো দেখাতে ব্যাংকগুলো এ সুবিধা নিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে আড়াল হচ্ছে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র।

ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করায় খেলাপিরা উৎসাহিত হচ্ছেন। তাদের ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা আরও বেড়েছে। অন্যদিকে, ব্যাল্যান্স শিট ভালো দেখাতে ব্যাংকগুলো এ সুবিধা নিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে আড়াল হচ্ছে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, বিতরণ করা ঋণের সমপরিমাণ অর্থ সঞ্চিতি হিসাবে রেখে ঋণ অবলোপন করতে হয়। সোনালী ব্যাংকও শত ভাগ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করে ঋণ অবলোপন করছে। যদিও প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার সঞ্চিতি ঘাটতি রেখে বছর-শেষে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করছে ব্যাংকটি। এক্ষেত্রে সঞ্চিতি ঘাটতি পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডেফারেল (বাড়তি সময়) সুবিধাও নিতে হচ্ছে সরকারের এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জুন-শেষে সোনালী ব্যাংক মোট ৫৪ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে মন্দ বা খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৯ শতাংশ। তবে অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে এর পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।

এসআই/এমএআর