ঋণ যাচ্ছে, ফেরত আসছে না। একক ব্যক্তির ঋণে চলছে বৃহৎ কেলেঙ্কারি। লোপাট হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এমন সব ঘটনা ঘটছে জনতা ব্যাংকের পাঁচটি শাখায়। গোটা ব্যাংকটি এসব শাখায় কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে।

তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে জনতা ব্যাংকের মোট ঋণ ছিল ৬৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাত্র পাঁচ শাখাতেই আটকে আছে পুরো ঋণের ৭২ শতাংশ। টাকার অংকে এর পরিমাণ ৪৫ হাজার ৬৬২ কোটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে জনতা ব্যাংকের ভয়াবহ এ চিত্র।

বর্তমানে জনতা ব্যাংকের শাখার সংখ্যা ৯১৭টি। কিন্তু ঋণের বেশিরভাগই এখন কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে কয়েকটি শাখায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব শাখায় বড় গ্রাহক খেলাপি হয়ে পড়লে বা ঋণ আটকে গেলে আদায় করতে বেগ পেতে হয়। এজন্য ঋণ বিতরণে অধিক গ্রাহক ও এলাকা বিস্তৃত করার কোনো বিকল্প নেই।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংকের অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল। দেশের কয়েকটি ভালো শিল্প গ্রুপকে অর্থায়নের মাধ্যমে শিল্পায়নে বড় ভূমিকা রেখেছিল ব্যাংকটি। এ কারণে সুনামও ছিল। কিন্তু গত ১০ বছরে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা আর অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে জনতা ব্যাংক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব শাখার মধ্যে রয়েছে জনতা ব্যাংক লোকাল অফিস, জনতা ভবন কর্পোরেট শাখা, লালদিঘী ইস্ট, সাধারণ বিমা ও দিলকুশা কর্পোরেট শাখা। চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত আলোচিত পাঁচ শাখা থেকে জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপিকে ৩৩ হাজার ২৫৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। যার ৬ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা মন্দ ঋণ। এর মধ্যে লোকাল অফিসের ৯ গ্রাহককে ঋণ দেওয়া হয়েছে মোট ১০ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৩ হাজার ২৩০ কোটি ৪০ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ। জনতা ভবন কর্পোরেট শাখা ৪ গ্রাহককে ঋণ বিতরণ করেছে ১১ হাজার ৫৭১ কোটি ৮১ লাখ টাকার, যার মধ্যে ৩ হাজার ৩৯৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা খেলাপি। এছাড়া লালদিঘী ইস্টে একজন গ্রাহক নিয়েছে এক হাজার ২২৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। সাধারণ বিমা শাখায় ৫ গ্রাহকের ৮ হাজার ২১০ কোটি এবং দিলখুশা কর্পোরেট শাখায় এক হাজার ২৮৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।

কয়েকটি শাখার মধ্যে ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়া মোটেও ভালো খরব নয় জানিয়ে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি কাঙ্ক্ষিত নয়, যত দ্রুত সম্ভব তাদের ঋণ অন্যান্য শাখার মাধ্যমে বিতরণ বাড়ানো জরুরি। পোর্টফোলিও ডাইভারসিফাইড করতে হবে। পাশাপাশি, যেসব শাখায় ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে তা বিশেষ ব্যবস্থায় আদায় কার্যক্রম জোরদার করা দরকার।

তিনি বলেন, বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারিগুলো কয়েকটি শাখার মাধ্যমেই হয়ে থাকে। নানা অনিয়ম করে ঋণ নেয়, পরে ফেরত দেয় না। এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যেন এসব কাজ না করতে পারে।  

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংকের অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল। দেশের কয়েকটি ভালো শিল্প গ্রুপকে অর্থায়নের মাধ্যমে শিল্পায়নে বড় ভূমিকা রেখেছিল ব্যাংকটি। এ কারণে সুনামও ছিল। কিন্তু গত ১০ বছরে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা আর অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে জনতা ব্যাংক।

ব্যাংকটির বর্তমান শাখার সংখ্যা ৯১৭টি। কিন্তু ঋণের বেশিরভাগই এখন কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে কয়েকটি শাখায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব শাখায় বড় গ্রাহক খেলাপি হয়ে পড়লে বা ঋণ আটকে গেলে আদায় করতে বেগ পেতে হয়। এজন্য ঋণ বিতরণে অধিক গ্রাহক ও এলাকা বিস্তৃত করার কোনো বিকল্প নেই।   

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের। জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ (প্রভিশন) বা শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে অর্থ সংস্থানেও ঘাটতি বেড়েছে ব্যাংকটির। জুন শেষে জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৫১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।

জনতা ব্যাংকের শীর্ষ গ্রাহকদের তালিকায় রয়েছে বহুল আলোচিত এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ। এক যুগ আগে নেওয়া এই দুই গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু ঋণ নেওয়া টাকা এখনো সম্পূর্ণ ফেরত আসেনি। অর্থ আদায়ে মামলা চলছে অর্থ ঋণ আদালতে। এছাড়া অন্য শীর্ষ গ্রাহকের তালিকায় রয়েছে এস আলম রিফাইন্ড সুগার অ্যান্ড আদারস, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লি., থার্মেক্স গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, বেক্সিমকো লি., রাংকা গ্রুপ, বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড কর্পোরেশন, অরিওন গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ ও যমুনা গ্রুপের মতো সুপরিচিত কোম্পানি।

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ঋণ আদায়ের জন্য যাদের বিরুদ্ধে ব্যাংক মামলা করে তারা সবাই প্রভাবশালী। মামলা করলেও তারা সেই মামলা আটকাতে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করে। এর ফলে অনেক খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি আরও ভালো হতো। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে দ্রুত রিট মামলাগুলো ‘ভ্যাকেট’ করার জন্য।

এসব বিষয়ে জানতে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদের সঙ্গে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে মতিঝিল জনতা ব্যাংক ভবনে এমডির নিজস্ব কার্যালয়ে সরাসরি গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মিটিংয়ের ব্যস্ততা দেখিয়ে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

তবে ব্যাংকটির সবশেষ বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ে জনতা ব্যাংকের এমডি আব্দুছ ছালাম আজাদ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে। এজিএমে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। গত বছর ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮৬৭ কোটি টাকা কমেছে। তারপরও আমাদের ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা। খেলাপি হওয়া এ ঋণের অর্ধেকের বেশি মাত্র কয়েকটি শিল্প গ্রুপের কাছে। এর মধ্যে থার্মেক্স, ক্রিসেন্ট, এননটেক্স ও আরএসআরএম গ্রুপের খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সহযোগিতা দরকার। মাত্র চারটি গ্রুপের ঋণ নিয়মিত হলে জনতা ব্যাংকের কোনো পিছুটান থাকবে না।

তিনি বলেন, থার্মেক্স, ক্রিসেন্ট ও এননটেক্স গ্রুপের ঋণই রয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ গ্রুপগুলোর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হলে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অর্ধেকে নামবে। তিনটি গ্রুপেরই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে ব্যাংকটির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) তুলে ধরা হয়েছে।

এজিএমে আব্দুছ ছালাম আজাদ ব্যাংকটির সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, ২০২০ সালে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত না হলে খেলাপি ঋণের হার আরও কমানো যেত।

এসআই/এসকেডি/জেএস