নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় চলছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিশেষায়িত দুটি ব্যাংক। লাগামহীন খেলাপি ঋণের কারণে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মূলধনেও দেখা দিয়েছে সংকট। দীর্ঘদিনের খেলাপি ঋণ আদায়ে নেই তেমন অগ্রগতি। এ কারণে বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)।

ব্যাংক দুটির আর্থিক প্রতিবেদন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে এমন চিত্র উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কৃষি খাতে ঋণপ্রবাহ জোরদারে বিশেষ আইনে প্রতিষ্ঠা করা হয় কৃষি ব্যাংক ও রাকাব। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে আসায় তাদের বিতরণ করা ঋণ সঠিক সময়ে আদায় হচ্ছে না। আদায় কম থাকায় খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রভিশন ও মূলধনে ঘাটতি, লোকসানে পতিত হওয়াসহ নানা সংকট দেখা দিয়েছে। তাদের বিনিয়োগযোগ্য সম্পদও কমে যাচ্ছে।

এমওইউতে খেলাপি ঋণ আদায়, আয় বাড়ানোসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে এর কোনো অগ্রগতি নেই। তারপরও গতানুগতিক নিয়মে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বছরের পর বছর এমওইউ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ব্যাংকের আর্থিক সূচক ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে সরকারি ব্যাংকগুলো। এমওইউতে খেলাপি ঋণ আদায়, আয় বাড়ানোসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে এর কোনো অগ্রগতি নেই। তারপরও গতানুগতিক নিয়মে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বছরের পর বছর এমওইউ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক। দেশের কৃষির মতো প্রকৃতিনির্ভর অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ খাতে অর্থায়নের জন্য ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় দেশের বৃহত্তম বিশেষায়িত ব্যাংকটি। শুরু থেকে এটি ভালোভাবেই চলছিল। এখন ব্যাংকটি দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার পাশাপাশি প্রভিশনে ঘাটতি ও মূলধন সংকটেও পড়েছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কৃষকদের সহায়তায় সরকারি সিদ্ধান্তে কৃষিঋণ ও সুদ মওকুফ করছে ব্যাংকটি। এতে কৃষক স্বস্তি পেলেও অস্বস্তিতে পড়ে ব্যাংকটি। বড় অঙ্কের মূলধন ঘাটতিতে পড়া প্রতিষ্ঠানটি এখন গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না।

চলতি বছরের জুন প্রান্তিক পর্যন্ত বিকেবির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই হাজার ৪০৬ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ২১ কোটি টাকা

কৃষকদের সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাংকটি পরিচালিত হলেও হঠাৎ করে ২০১০ সালে শিল্প খাতে বড় ঋণ বিতরণ করে বিকেবি। পোশাক শিল্প, কোল্ডস্টোরেজসহ আরও কিছু বড় শিল্পে ঋণ দেয়। এ ঋণের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এসব ঋণ সময় মতো আদায় না হওয়ায় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হঠাৎ অনেক বেড়ে যায়। বর্তমানে যে খেলাপি ঋণ রয়েছে তার বেশির ভাগই শিল্প খাতে।

সারাদেশে ব্যাংকটির শাখা রয়েছে এক হাজার ৩৮টি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন প্রান্তিক পর্যন্ত বিকেবির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই হাজার ৪০৬ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ২১ কোটি টাকা।

নানামুখী সংকটে থাকা বিকেবির মূলধন ঘাটতি দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। জুন প্রান্তিকে যেখানে বেশকিছু ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মূলধন রাখায় সামগ্রিক ব্যাংক খাতে ১৫ হাজার ৩৫ কোটি টাকার উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে। ওই সময়ে বিকেবির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণ আদায় ও মূলধন ঘাটতি কমানোসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শিরীন আখতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ইন্টারভিউ বোর্ডে আছি, ব্যস্ত আমি। এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে পারব না।’

রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক

রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকদের জন্য গঠিত হয় বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। সেখানেও নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা চলছে বলে অভিযোগ আছে। খেলাপি ঋণের ভারে ব্যাংকটির অবস্থা এখন নড়বড়ে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ায় ব্যাংকটির দেড়শোর অধিক শাখাকে লোকসান গুনতে হচ্ছে।

চলতি বছরের জুন শেষে রাকাবের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছয় হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৯ দশমিক ২৯ শতাংশ বা এক হাজার ২১২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। পাশাপাশি ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি রয়েছে এক হাজার ৫০৬ কোটি টাকা

ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, রাকাবের মোট ৩৮৩টি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে শহরে রয়েছে ৫০টি, পল্লী শাখা ৩৩৩টি। এসব শাখার মধ্যে ১৫১টি লোকসানে রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছয় কোটি ৭৫ লাখ টাকা লাভ করে ব্যাংকটি। এরপর টানা চার বছর লোকসান গুনছে রাকাব। সর্বশেষে গেল ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা আয় করে ব্যাংকটি। এর বিপরীতে ব্যয় হয় ৫৮৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। ফলে লোকসান গুনতে হয় তিন কোটি ১০ লাখ টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে রাকাবের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছয় হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৯ দশমিক ২৯ শতাংশ বা এক হাজার ২১২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। পাশাপাশি ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি রয়েছে এক হাজার ৫০৬ কোটি টাকা।

রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, গত বছর খেলাপি ঋণ আরও বেশি ছিল। আমরা তা কমিয়ে এনেছি। এখন ১৯ শতাংশে আছে। ঋণ আদায়ে পাঁচ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করছি আগামী ডিসেম্বরে এটি আরও কমে আসবে।

এসআই/এমএআর/