দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও প্রচেষ্টায় প্রবাসী ছেলেকে দেখতে মালয়েশিয়া যান মমতাময়ী এক মা। কাগজপত্রের জটিলতায় ছেলে দীর্ঘদিন ধরে দেশে আসতে পারছিলেন না। তাই তো মাকে কাছে পেয়ে ছেলেও আবেগে আপ্লুত। বেশ কিছুদিন ছেলের কাছে থাকার পর মা এবার দেশে ফিরবেন। ফেরার দিন ছেলে মাকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে চেক ইন করে তার কাজে ফিরে যায়। ফ্লাইট ঠিক মতোই ছেড়েছে, ঢাকায়ও নেমেছেন মা। কিন্তু মায়ের খোঁজ নেই। বাসায়ও ফেরেননি। দেশে থাকা স্বামী-সন্তানরা বহু চেষ্টার পর জানতে পারলেন, অবৈধ স্বর্ণ বহনের জন্য মা কাস্টমসের হাতে ধরা পড়েছেন। মামলায় দ্রুত বিচারে মায়ের ছয় মাসের জেলও হয়।

ঘটনাটি ২০১৯ সালের অক্টোবরে। সেদিন মালয়েশিয়ায় ইমিগ্রেশন শেষ করে ওই মা ভেতরে যেতেই বাংলাদেশি একজনের সঙ্গে তার দেখা হয়। কালো একটি ব্যাগ দিয়ে ওই ব্যক্তি খুব মিনতি করে বলেন- ‘আন্টি, আপনার লাগেজ কম। এখানে আমার মেয়ের জন্য চকলেট আছে। ঢাকায় কষ্ট করে পৌঁছে দেবেন। এয়ারপোর্টে আমার লোক থাকবে।’ সরল বিশ্বাসে অন্যের উপকার করতে গিয়ে তার ঠিকানা হলো জেলখানা!

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ হরহামেশাই বিমানবন্দরে স্বর্ণসহ যাত্রী আটকের ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই স্বর্ণের মূল মালিকরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকেন। ধরা পড়েন এমন বাহকরা। কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ব্যাগেজ রুলস যথাযথভাবে জানা থাকলে এড়ানো সম্ভব অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা।

কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী কর্মজীবনের বড় একটি সময় ঢাকা কাস্টম হাউস ও বেনাপোল কাস্টম হাউসে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা কাস্টমসে কমিশনার হিসাবে কর্মরত আছেন।

ঢাকা পোস্টকে এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিমানবন্দর ও বর্ডারের যাত্রীদের ব্যাগেজ রুলস ও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো জানা থাকলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব। অপরিচিত বা অল্প পরিচিতের কথায় ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। অপরিচিত ব্যক্তি এবং ব্যাগেজকে বিশ্বাস করা ঝুঁকিপূর্ণ। না জেনে অন্য কারো দেওয়া মালামাল বহন করা যাবে না। আমার কর্মজীবনে অনেক প্রবাসীকে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদে পড়তে দেখেছি। বিপদমুক্ত থাকতে হলে জানতে হবে ব্যাগেজ রুলস ও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালা, ২০১৬ প্রণয়ন করে। সেই বিধিমালা ও বাস্তবতার আলোকে কয়েকটি ধাপে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে ভাগ করা হয়েছে।

গ্রিন চ্যানেল: যাত্রীর ব্যাগেজ শুল্কমুক্ত হলে গ্রিন চ্যানেল দিয়ে বের হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বিধিমালার তফসিল-১ এর ফরমে (ফ্লাইট নামার আগে বিমানে দেওয়া হয়) ঘোষণা দিতে হবে। গ্রিন চ্যানেলে যাত্রীদের স্ক্যান ও পরীক্ষা হবে। কাস্টমস অফিসার চাইলে যে কারো ব্যাগ স্ক্যান বা খুলে পরীক্ষা করতে পারে। যদি যাত্রীর শুল্ক করযুক্ত পণ্য থাকে সেক্ষেত্রে রেড চ্যানেলে শুল্ককর পরিশোধ করতে হবে।

ব্যাগেজ বিধিমালা অনুয়ায়ী বিদেশ থেকে আসা কিংবা বিদেশগামী যাত্রীকে পণ্য বহনের ক্ষেত্রে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে নজর দিতে হবে।

টেলিভিশন : বিদেশি টেলিভিশন ২৯ ইঞ্চি পর্যন্ত শুল্কমুক্তভাবে আনা যাবে। আর টেলিভিশন যদি ৩০-৩৬ ইঞ্চি হয় তাহলে ১০ হাজার টাকা, ৩৭-৪২ ইঞ্চি হলে ২০ হাজার, ৪৩-৪৬ ইঞ্চি হলে ৩০ হাজার, ৪৭-৫২ ইঞ্চি হলে ৫০ হাজার, ৫৩-৬৫ ইঞ্চি হলে ৭০ হাজার এবং ৬৬ ইঞ্চির বেশি হলে ৯০ হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।

সিগারেট : এক কার্টন (২০০ শলাকা) পর্যন্ত সিগারেট শুল্কমুক্ত হিসেবে আনতে পারবেন যাত্রী। এর বেশি আনলে কাস্টমস তা আটক করবে। আটক করা সিগারেট বিধি অনুযায়ী বিক্রয়/ধ্বংসযোগ্য। তাই ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

মদ ও মদ জাতীয় পানীয় : বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী নাগরিকদের জন্য মদ আনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আনলে কাস্টমস তা অবশ্যই আটক করবে। বিদেশি পাসপোর্টধারী নাগরিক হলে ২ বোতল বা সর্বোচ্চ ১ লিটার পর্যন্ত আনতে পারবেন। এর বেশি আনলে কাস্টমস তা আটক করবে।

ল্যাপটপ : একটি ল্যাপটপ শুল্কমুক্ত হিসেবে আনার সুবিধা পাওয়া যাবে। দুটি হলে প্রায় ১৬ শতাংশ শুল্ক-কর পরিশোধ সাপেক্ষে আনা সম্ভব। এর বেশি হলে কাস্টমস আটক করবে। আর আটক করা ল্যাপটপ পরে আমদানি ও রফতানি নিয়ন্ত্রক দফতরের ছাড়পত্র উপস্থাপন, শুল্ক-করাদি এবং অর্থদণ্ড পরিশোধ সাপেক্ষে ফেরত পেতে পারে যাত্রীরা।

স্বর্ণবার : স্বর্ণবারের ক্ষেত্রে প্রতি ১১.৬৭ গ্রামের জন্য ২ হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। এভাবে ঘোষণা দিয়ে ২৩৪ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণ আনতে পারবে যাত্রী। এর বেশি আনলে কাস্টমস তা আটক করবে। ঘোষণা না দিয়ে গ্রিন চ্যানেল অতিক্রমের সময় স্বর্ণবার বহনকারী হিসাবে ধরা পরলে তা চোরাচালান হিসেবে গণ্য হবে। অপরাধের দায়ে শুল্ক-কর আরোপসহ অতিরিক্ত হিসেবে পণ্যমূলের দ্বিগুণ জরিমানা আরোপ হতে পারে।

স্বর্ণালংকার : শুল্ক কর পরিশোধ না করে একজন যাত্রী ১০০ গ্রাম পর্যন্ত (এক প্রকারের অলংকার ১২টির বেশি হবে না) শুল্কমুক্ত স্বর্ণালংকার আনতে পারবেন। এর বেশি আনলে অতিরিক্ত প্রতি গ্রামের জন্য প্রায় ২ হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। বাণিজ্যিক পরিমাণ বলে মনে হলে কাস্টমস তা আটক করবে। আটক করা স্বর্ণালংকার পরে Adjudication প্রক্রিয়ায় শুল্ক-কর এবং অর্থদণ্ড পরিশোধ সাপেক্ষে ফেরত পেতে পারেন। আর চোরাচালান বলে মনে হলে কাস্টমস সরাসরি ফৌজদারি মামলা করবে।

মোবাইল ফোন : একজন যাত্রী নিজের ব্যবহৃতসহ সর্বমোট ২টি মোবাইল ফোন শুল্কমুক্ত হিসেবে আনতে পারবেন। শুল্ক-করাদি পরিশোধ সাপেক্ষে (প্রায় ৫৫.৬০ শতাংশ) ৩-৮টি পর্যন্ত মোবাইল আনতে পারবেন। এর বেশি আনলে কাস্টমস তা আটক করবে।

নতুন শাড়ি, অন্যান্য কাপড় ও কসমেটিক্স : ব্যাক্তিগত বিবেচনায় যুক্তিসংগত পরিমাণ শুল্কমুক্ত হিসেবে আনতে পারবেন। আরও কিছু পরিমাণ শুল্ক-করাদি (প্রায় ১২৮/১৫০ শতাংশ) পরিশোধ সাপেক্ষে আনতে পারবেন। তবে পরিমাণে বেশি আনলে বাণিজ্যিক বিবেচনায় কাস্টমস তা আটক করবে।

ওষধ : জরুরি বিবেচনায় প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে যুক্তিসংগত পরিমাণ ওষধ আনতে পারবেন। বাণিজ্যিক পরিমাণ বলে মনে হলে কাস্টমস তা আটক করবে। তবে আটককৃত ওষধ পরবর্তীতে ওষধ প্রশাসন অধিদফতরের ছাড়পত্র উপস্থাপন, শুল্ক-কর এবং অর্থদণ্ড পরিশোধ সাপেক্ষে ফেরত পেতে পারেন।

বৈদেশিক মুদ্রা : বিদেশে যাওয়ার সময় পাসপোর্টে এনডোরস [বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত ক্ষেত্র ব্যতিত] ব্যতিত কোনো বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্গে নিতে পারবেন না। তবে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ হাজার টাকা পাসপোর্টে এনডোরস ছাড়াই সঙ্গে নিতে পারবেন। এনডোরস ব্যতিত এর বেশি বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্গে নিলে কাস্টমস আটক করবে। আর মুদ্রা পাচার/মানি লন্ডারিং বলে মনে হলে কাস্টমস সরাসরি ফৌজদারি মামলা করবে। বিদেশ থেকে ফেরার সময় ইচ্ছেমত বৈদেশিক মুদ্রা আনতে পারবেন। তবে ১০ হাজার ডলার/সমমান এর বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আনলে অবশ্যই কাস্টমসের কাছে এফএমজে (FMJ) ফরম-এ ঘোষণা দিতে হবে।

সাময়িক আটক : শুল্ক-করাদি পরিশোধ সাপেক্ষে খালাসযোগ্য পণ্যের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক শুল্ক-করাদি পরিশোধ করার মতো টাকা সঙ্গে না থাকলেও ভয়ের কিছু নেই। সেক্ষেত্রে কাস্টমস তা সাময়িকভাবে আটক করবে। আটক রশিদ (Detention Memo) বুঝে নেবেন। সাময়িকভাবে আটক করা পণ্য ২১ দিনের মধ্যে যথাযথ শুল্ক-করাদি পরিশোধ সাপেক্ষে ফেরত পেতে পারেন।

কার্গো বুকিং পণ্য ঘোষণা : বিদেশ থেকে আসার আগে কার্গোতে ব্যক্তিগত মালামাল বুকিং দিয়ে আসলে বাংলাদেশে নেমেই সাত দিনের মধ্যে এয়ারপোর্ট কাস্টমস এর কাছে এয়ারওয়ে বিল এবং পাসপোর্টসহ উপস্থিত হয়ে নির্ধারিত 'এ-ফরম' পূরণ করে মালামাল এর ঘোষণা করবেন। অনুমোদিত 'এ-ফরম' এর কপি নিয়ে মালামাল আসার পর শুল্ক-করাদি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) পরিশোধ সাপেক্ষে এয়ারফ্রেইট ইউনিট থেকে মালামাল নিতে পারেন।

মৃত ব্যক্তির ব্যাগেজ : বাংলাদেশি কোনো নাগরিক বিদেশে মারা গেলে মৃত ব্যক্তির ব্যাগেজ সব শুল্ক কর পরিশোধ ব্যতিরেকে খালাস করা যাবে।

হুইলচেয়ার : অসুস্থ পঙ্গু বৃদ্ধ যাত্রীর হুইল চেয়ার ও ব্যবহার্য্য চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সব শুল্ক কর পরিশোধ ব্যতিরেকে খালাস করা যাবে।

আরএম/জেডএস