ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে রাজধানীর বাইরে। ২৬তম এই আসরের স্থান হয়েছে রাজধানীর অদূরে পূর্বাচল উপশহরের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে। যা রাজধানীর আগের বাণিজ্য মেলার মাঠ থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার এবং কুড়িল বিশ্বরোড থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে।

২০২১ সালের বাণিজ্য মেলার আসরটিও এ ভেন্যুতে হওয়ার কথা থাকলেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সেটি স্থগিত করা হয়। তাই মেলার ২৬তম আসর এ ভেন্যুতে আয়োজন করা হয়েছে। তবে মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ মেলা সফলভাবে সমাপ্ত করতে দুটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি হচ্ছে ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। অন্যটি হচ্ছে করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে তা যদি আগামীতেও অব্যাহত থাকে তাহলে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার। এ অবস্থায় যেকোনো সময় মেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন অংশগ্রহণকারী।

তারা বলছেন, এবারের বাণিজ্য মেলা নতুন একটি স্থানে আয়োজন করা হয়েছে। যা রাজধানী থেকে অনেক দূরে। তাছাড়া গণপরিবহনের সুবিধা অপ্রতুল। তাই শুরুর দিন থেকেই ক্রেতার উপস্থিতি অনেক কম। এ পরিস্থিতি আগামীতে চলতে থাকলে ব্যাপক লোকসান গুনতে হবে তাদের। 

এদিকে মেলায় দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের রাজধানী থেকে যাতায়াতের সুবিধার্থে কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচ থেকে প্রতিদিন ৩০টি বিআরটিসি বাস ও অন্যান্য যাত্রীবাহী বাস চলাচল করছে। এসব বাসে জনপ্রতি ভাড়া ৪০ টাকা। বাস থেকে নামতে হবে কাঞ্চন ব্রিজের আগে। সেখান থেকে ১০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে মেলা প্রাঙ্গণে যেতে হচ্ছে।

অন্যদিকে বৃহস্পতিবার (৬ জানুয়ারি) স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ১৪০ জন। করোনায় এ পর্যন্ত দেশে ২৮ হাজার ৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে; শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৮৯ হাজার ৯৪৭ জনে।

জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জার (জিআইএসএআইডি) তথ্য মতে, দেশে এখন পর্যন্ত (৬ জানুয়ারি) ২০ জনের ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর দেশে প্রথম দুজনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্তের কথা জানা যায়।

এই দুই চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে গত ছয় দিন ধরে চলছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার ২৬তম আসরটি। মেলা শুরুর ছয় দিন অতিবাহিত হলেও এখনও জমে ওঠেনি মেলা।

মেলায় থাকা স্টলগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের মেলাটি সত্যিই চ্যালেঞ্জের। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানই এবার মেলায় যুক্ত হয়নি।

বিক্রেতারা বলছেন, মেলা রাজধানী থেকে দূরে হওয়াতে রাজধানীর মানুষজন কম আসছে। যারা আসছেন তারা আশেপাশের এলাকার। তারা প্রকৃতপক্ষে ক্রেতা নন, শুধুমাত্র দর্শক। তাদের দিয়ে বাণিজ্য মেলার সার্থকতা আসবে না। তবে মেলা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুক্রবার থেকে মেলায় আগতদের সংখ্যা বাড়তে পারে।

মেলায় আরএফএল প্লাস্টিকের সেলস এক্সিকিউটিভ সুজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এর আগেও শেরেবাংলা নগরের মেলার মাঠে মেলা করেছি। সেই ধারণা থেকে আমার মনে হচ্ছে, এখানে মেলা জমে উঠতে অন্তত ৪ থেকে ৫ বছর সময় লাগবে। প্রথমবার এখানে মেলা হওয়াতে মানুষজনের উপস্থিতি কম। তাই, টুকটাক বিক্রি হচ্ছে।

একটি শাল ও চাদর দোকানের ইনচার্জ সুমন বলেন, আল্লাহ ওপর ভরসা করে এই মেলায় দোকান নিয়েছি। আমার সঙ্গে আগের মেলার মাঠে যারা দোকান নিত, তাদের অনেকেই এবার এখানে দোকান নেয়নি। কেমন হবে জানি না। তবে এখানে মেলা জমতে কয়েক বছর সময় লাগবেই।

শেরেবাংলা নগরের মেলার মাঠে ফুড কোর্টগুলো কখনও খালি থাকতে দেখা যায়নি। তবে মেলার ৬ষ্ঠ দিন ঘুরে ফুড কোর্টগুলো অনেকটা খালি দেখা গেছে। সেখানে থাকা মিঠাইয়ের সেলস এক্সিকিউটিভ মো. আতিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেখানে মানুষের সমাগম বেশি, সেখানেই খাবার বেশি বিক্রি হয়। এই মেলার মাঠে অল্প সংখ্যক মানুষ, আপনি নিজেই দেখতে পারছেন। ফুড কোর্ট এলাকা অনেকটাই ফাঁকা। কিছু বিক্রি হচ্ছে, তবে এখনও ভালো বলা যাচ্ছে না।

ওয়ালটানের প্যাভিলিয়নে মেলার অবস্থা নিয়ে কথা হয় কম্পিউটার সেকশনের ইঞ্জিনিয়ার রিফাত রহমানের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলে এমন একটা জায়গায় মেলা হচ্ছে, যেখানে যোগযোগ ব্যবস্থা নিরাপদ নয়। এখনও সন্ধ্যার পর ৩০০ ফিট রাস্তায় মানুষ পরিবার নিয়ে চলতে ভয় পায়। তাই, গত ছয় দিনে দেখেছি সন্ধ্যা ৬টার পর মেলার মাঠে বেশি মানুষ থাকে না। এদিকে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন দেশে হানা দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ১৫ জানুয়ারির পর মেলা বন্ধ ঘোষণা করা হয় কি না, সে নিয়েও আমাদের সংশয় আছে। এবারের মেলা আসলেই চ্যালেঞ্জিং।

নাভানা ফার্নিচারের সেলস এক্সিকিউটিভ আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ছয় দিনে এখানে যারা এসেছেন তারা সবাই দর্শনার্থী, ক্রেতা নেই। জানি না সামনে কী হবে। মেলার ১৫ দিন পর বোঝা যাবে আসলে এবারের এই মেলা লস না লাভের।

মেলা সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্রেতা খরার মধ্য দিয়েই প্রায় প্রথম সপ্তাহ পার করছে এবারের ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। তবে মেলার প্রথম চার দিনে মোট উপস্থিতি ছিল মাত্র ৩০ হাজার। শুক্রবার থেকে এই সংখ্যা বাড়তে পারে।

উল্লেখ্য, দেশীয় পণ্যের প্রচার, প্রসার, বিপণন ও উৎপাদনে সহায়তা দেয়ার লক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর যৌথ উদ্যোগে ১৯৯৫ সাল থেকে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার আয়োজন করেছে। মেলার আগের ২৫টি আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের মাঝের খোলা জায়গায়। এবারই প্রথমবারের মতো স্থায়ী কমপ্লেক্সে এ মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

এমএইচএন/এসকেডি