করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে উদ্বেগজনক ধরন হিসেবে বর্ণনা করেছে। নতুন এ ধরনের বিস্তার নিয়ে উদ্বিগ্ন গোটা বিশ্ব। জারি হচ্ছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা।  বাংলাদেশেও শনাক্ত হয়েছে ওমিক্রন। ফলে শুধু স্বাস্থ্য খাতই নয়, দেশের অর্থনীতির ওপরও চোখ রাঙাচ্ছে করোনার নতুন এ ধরন। কারণ, বাংলাদেশের পণ্য রফতানির প্রধান গন্তব্য ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র। ওমিক্রন সংক্রমণে সেখানে এখন ‘নাস্তানাবুদ’ অবস্থা। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ভাইরাসটির বিস্তার রোধে নতুন করে স্বাস্থ্যবিধি জারি করেছে সরকার।

নতুন করে আতঙ্ক ছড়ানো ওমিক্রনের প্রভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় থাকা অর্থনীতি কি আবারও হোঁচট খাবে? দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি ব্যাংক খাতে কোন ধরনের প্রভাব পড়তে পারে— এসব বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় বিশিষ্ট ব্যাংকারদের। তাদের মন্তব্য, ওমিক্রনে কিছুটা শঙ্কা দেখা দিলেও আতঙ্কিত নন তারা। এর মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে, একই সঙ্গে জীবন ও জীবিকা সচল রাখতে হবে।

লকডাউন প্রসঙ্গে তারা বলেন, এটি কোনো সুফল বয়ে আনবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। এখন নতুন নতুন রফতানি আদেশ আসছে। আমদানি বাণিজ্যও চাঙা। এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্ক হয়ে চললে ওমিক্রনও মোকাবিলা করা সম্ভব।

লকডাউন কোনো সুফল বয়ে আনবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। এখন নতুন নতুন রফতানি আদেশ আসছে। আমদানি বাণিজ্যও চাঙা। এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্ক হয়ে চললে ওমিক্রনও মোকাবিলা করা সম্ভব

দেশের ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) নতুন চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম আর এফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের আরেকটি উপসর্গ ওমিক্রন। নতুন এ ভেরিয়েন্টের বিস্তার রোধে সরকার কিছু বিধিনিষেধ দিয়েছে। আমি মনে করি, এটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। কারণ, এখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার কথা বলা হয়নি। পুরোপুরি লকডাউন দেওয়া হয়নি। যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা মেনে চলা কঠিন কিছু নয়। এটি মানলে আমরা আমাদের অর্থনীতি খুব সুন্দরভাবে এগিয়ে নিতে পারব।’

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি ও সিইও সেলিম আর এফ হোসেন / ছবি- সংগৃহীত

‘নতুন বিধিনিষেধের কারণে কয়েকটি খাত যেমন- হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট, পর্যটন ও পরিবহন খাত কিছুটা সমস্যায় পড়বে। তবে, এ মুহূর্তে বিধিনিষেধ পরিপালন খুবই জরুরি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েছে।’

ব্যাংক খাতে ওমিক্রনের কেমন প্রভাব পড়তে পারে— জানতে চাইলে সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, গত দুই বছর বিভিন্ন ছাড়ের কারণে পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। ঋণ শোধ না করেও কেউ খেলাপি হননি। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ছাড় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদন বলে দেবে ব্যাংক খাত আসলে কোন অবস্থায় আছে।

‘অনেক ব্যবসায়ীর ঋণ পরিশোধের ইচ্ছা আছে কিন্তু দিতে পারছেন না। আবার অনেকের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা আছে কিন্তু ইচ্ছা নাই। এ ক্ষেত্রে ঋণের টাকা ফেরত আনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের বিভিন্ন সেক্টর সহযোগিতা করবে— এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’

তিনি বলেন, দুই বছর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এখন ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তবে যদি কোনো ব্যবসায়ী বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন তাদের অবশ্যই ব্যাংক দেখবে এবং সম্পর্কের ভিত্তিতে সহযোগিতা করা হবে।

‘বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি অন্য সব দেশের চেয়ে অনেক চাঙা’— উল্লেখ করে এবিবি’র এ নেতা বলেন, ‘বিধিনিষেধের কারণে দু-একটি খাত হয়তো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, তবে সার্বিকভাবে খুব একটা ক্ষতি হবে না। যেভাবে বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে, এটা পরিপালন করা সহজ। এর মধ্যে কাজ করা তেমন কঠিন নয়। এখন আমাদের রফতানি বেড়েছে। তৈরি পোশাক খাতে নতুন নতুন অর্ডার আসছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হচ্ছে। সামনের দিনগুলো ভালোই যাবে—প্রত্যাশা সেলিম আর এফ হোসেনের।

অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ও সিইও মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম / ছবি- সংগৃহীত

এ বিষয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা এখন আমাদের জীবনের একটা অংশ। এটা মনে করেই জীবন-জীবিকা একসঙ্গে চালাতে হবে। আমরা নিজেরা সতর্ক থাকব, পাশাপাশি স্বাস্থ্যসুরক্ষা মেনে আমাদের গ্রাহক ও ব্যাংকারদের সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেব। এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি, আশা করি সেভাবে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্ক হয়ে চললে আশা করি ওমিক্রন মোকাবিলা করা সম্ভব।

‘নতুন বছরটা আমরা ভালোভাবেই শুরু করেছি। ওমিক্রনের প্রভাবে একটু আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। তবে, আশা করছি বড় কিছু হবে না। দেশের অর্থনীতি এখন ভালো অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। রফতানি আদেশ আসছে, সঙ্গে আমদানি চাহিদাও বাড়ছে। গত দুই বছরে যে ক্ষতি হয়েছে, আশা করি সেটা কাটিয়ে নতুন বছরে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হব’— বলেন শামস-উল ইসলাম।

চতুর্থ প্রজন্মের মধুমতি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সফিউল আজম বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আমরা যে আভাস পেয়েছি, এবার আগের মতো কঠোর লকডাউন দেওয়া হবে না। আগের লকডাউনে দোকানপাট ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। মানুষের চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে দেশের সার্বিক অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে যায়। এবার ওমিক্রন ঠেকাতে সরকার বিধিনিষেধ দিয়েছে। সরকার চাচ্ছে সবাই যেন মাস্ক পরে, জনসমাগম এড়িয়ে সবাই যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। এটা কিন্তু আমাদের এবং দেশের জন্য ভালো সিদ্ধান্ত।’

মধুমতি ব্যাংকের এমডি ও সিইও মো. সফিউল আজম / ছবি- সংগৃহীত  

‘করোনার কারণে গত দুই বছর (২০২০ ও ২০২১ সাল) আমরা যে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছি এখন কিন্তু তেমনটি নয়। প্রথম যখন করোনা এসেছিল, ওই সময় ভাইরাসটা সবার কাছে নতুন ছিল। কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে সেই সম্পর্কে জানা ছিল না। এমনকি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করেছিল। সবমিলিয়ে আমাদের নতুন একটা পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছিল। কিন্তু এখন আমরা অনেক সচেতন। অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন, ভ্যাকসিন দিচ্ছেন। আমি মনে করি, করোনাভাইরাস থাকবে। এটি মোকাবিলা করেই আমাদের চলতে হবে।’

সফিউল আজম বলেন, এখন আমাদের উচিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া ভাইরাস প্রতিরোধের বিধিনিষেধ যথাযথভাবে প্রতিপালন করা। যারা বিধিনিষেধ মানবেন না তাদের আইনের আওতায় আনা এবং শাস্তি নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, সবাইকে টিকার আওতায় আনা। তা হলেই করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন মোকাবিলা করা সম্ভব এবং আমাদের অর্থনীতিকেও টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

‘করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ছাড় দিতে হবে। তবে, একবারেই ঋণ পরিশোধ না করার সুযোগ দেওয়া যাবে না’— উল্লেখ করে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ব্যবসায়ীদের কিছুটা ছাড় দেওয়া যেতে পারে। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়ে আসছে। প্রথম বছর ঋণের টাকা পরিশোধ না করেও খেলাপি থেকে মুক্ত ছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। দ্বিতীয় বছর ২৫ শতাংশ, পরবর্তীতে এটা আরও বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের সাপোর্ট দিতে হবে— এটা ঠিক আছে। তবে কোনোমতেই একেবারে ছাড় দেওয়া যাবে না। কারণ, গ্রাহক ঋণ শোধ না করলে ব্যাংকগুলো চলবে কীভাবে?’

এসআই/এমএআর/