করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সাল জুড়ে ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ২০২১ সালেও ছিল বিশেষ সুবিধা, কিস্তি পরিশোধে পেয়েছেন ছাড়। ২০২২ সালে ছাড় উঠে গেলেও, গ্রাহকের ঋণ পরিশোধ না করার রেশ কাটেনি। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়ে সোয়া লাখ কোটি টাকার নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে বাংলাদেশ।

সেই সঙ্গে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ (প্রভিশন) বা শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে অর্থ সংস্থানে ঘাটতিতে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি ৯ ব্যাংক।

নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি, বেসরকারি, বিদেশিসহ সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, তার গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্য এ প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি জুন শেষে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি অগ্রণী, বেসিক, জনতা, রূপালী, বেসরকারি বাংলাদেশ কমার্স, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল, সাউথইস্ট ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৯৩১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।

ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখানোর জন্য প্রভিশন সংরক্ষণে কোনো কোনো ব্যাংককে কয়েক বছরের সময় দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে কারণে প্রকৃত ঘাটতির বিষয়টি সামনে আসছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি জুন শেষে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি অগ্রণী, বেসিক, জনতা, রূপালী, বেসরকারি বাংলাদেশ কমার্স, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল, সাউথইস্ট ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৯৩১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।

তবে কিছু কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করায় পুরো ব্যাংকিং খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ১২০ কোটি টাকা।

ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ সাত হাজার ১১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৩৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা এবং সাউথইস্ট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১০২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।

নয়টি ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক রয়েছে চারটি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে বেসিক ব্যাংকের। জুন শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৪৪১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর পরেই রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। এই ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দুই হাজার ৯৭৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে রূপালী ব্যাংক লিমিটেড। দুই হাজার ৯৬২ কোটি ১০ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকটি। চতুর্থ অবস্থানে থাকা জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৬৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত এ চার ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতিই ১১ হাজার ১৭ কোটি টাকা। তবে ব্যতিক্রম রয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন দুই ব্যাংক। যারা অতিরিক্ত প্রভিশন রাখতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে সর্ববৃহৎ সোনালী ব্যাংকের প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি অতিরিক্ত রয়েছে ৩৮০ কোটি ২৭ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের অতিরিক্ত রয়েছে ১৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

এছাড়া বেসরকারি ৫টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৭ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ সাত হাজার ১১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৩৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা এবং সাউথইস্ট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১০২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।

তবে অতিরিক্ত প্রভিশন রেখে নজির স্থাপন করেছে বেসরকারি মালিকানাধীন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ব্যাংকটি এককভাবে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করেছে। এ ব্যাংকটি একাই প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত দুই হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা প্রভিশন রেখেছে। এর পরেই রয়েছে বেসরকারি খাতের অপর ব্যাংক প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড। এই ব্যাংকটি অতিরিক্ত ৫৮৬ কোটি এবং পূবালী ব্যাংক রেখেছে ৫১০ কোটি টাকার অতিরিক্ত প্রভিশন। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে ওই ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। ব্যাংক যদি প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার শঙ্কা থাকে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংকের ওপর। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় আমানত।

প্রসঙ্গত, চলতি ২০২২ সালের জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

তিন মাস আগে মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সে হিসেবে ৩ মাসে খেলাপি বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুন প্রান্তিক শেষে খেলাপি ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের তুলনায় তুলনায় খেলাপি বেড়েছে ২৬ হাজার ৫২ কোটি টাকা। দেশের ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, করোনাকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার যে সুবিধা দিয়েছে, তা গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী করে তুলেছে। গত দুই বছর ব্যবসায়ীরা ঋণ শোধ না করেও ব্যাংকের খাতায় ভালো গ্রাহক ছিলেন। এ অবস্থায় গত জুলাইয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে যোগ দেওয়ার পর বড় ধরনের ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলেই সামনে অবশ্য কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমে আসবে।

তবে খেলাপিদের বিশেষ এ ছাড় ব্যাংক খাতের জন্য আরোও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ছাড় পেতে পেতে এমন অবস্থা হয়েছে যে, খেলাপিরা এখন মনে করছে আমি ঋণ পরিশোধ না করলে আগামীতে আরো ছাড় পাব। এ কারণে যতদিন ছাড় থাকবে ততদিন এ খেলাপি বাড়তেই থাকবে। তাই খেলাপি কমাতে হলে ছাড় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। কঠিনভাবে আইন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এর কোনো বিকল্প উপায় নেই।

এসআই/জেডএস